Friday 4 November 2016

15 temples in Bangladesh vandalised, houses of Hindus looted

Temples in Brahmanbarhia district’s Nasirnagar were vandalised on Sunday; besides over 100 houses of Hindus in the area have also been looted. After the mayhem for hours, two temples in adjacent Habiganj’s Madhabpur also came under attack, police and witnesses said. Six persons were arrested for their alleged involvement in the attack.
Paramilitary Border Guards Bangladesh (BGB) have been deployed in Nasirnagar and Madhabpur Upazila headquarters along with the Rapid Action Battalion, police and Armed Police Battalion, bdnews24.com reported. The district’s Deputy Commissioner Rezwanur Rahman and Superintendent of Police Mizanur Rahman inspected the area later in the afternoon. But the leaders of the local Hindu community say the panic that has gripped them is not going away.
Ditto, attack on Buddhists
The attack was carried out in a style followed by the attackers of Buddhist community in Cox’s Bazar in 2012 on a similar allegation of disrespect towards Islam through a Facebook post.
Locals said Nasirnagar incident started with a Facebook post by one Rasraj Das from Harinberh village under Haripur Union Parishad. Police detained Rasraj on Friday immediately after the allegation of blasphemy had surfaced against him. He was sent to jail following a court order, Mr. Mizanur Rahman said. Protests against Rasraj’s post were called under the banner of ‘Ahle Sunnat Wal Jamaat’ in Habiganj district headquarters and Nasirnagar. Demonstrations were also announced in Habiganj’s Madhabpur.
Madrasa students stage protest
A group of madrasa students demonstrated on the premises of Brahmanbarhia Press Club while hundreds of people blocked Sarail-Nasirnagar-Lakhai road by torching tyres on Sunday. Mr. Mizanur, quoting witnesses, said a group of the demonstrators, armed with local weapons, vandalised the temples at Duttubarhi, Namashudraparha and Ghoshparha, and Jagannath Temple and Goura Temple.
They also vandalised and looted the houses of the Hindu families. Several priests were injured in the attack, he said. One platoon of the BGB was deployed first to bring the situation under control. The other forces joined them later.
Mr. Mizanur said preparations to file separate cases over the attacks were under way. Mr. Rezwanur Rahman told the media that those responsible for the attack would get ‘exemplary’ punishment after investigation. Nasirnagar Upazila Parishad Vice-Chairman Anjan Deb said, “The situation is apparently calm now but the Hindu community is still panicked.”

Wednesday 5 October 2016

ভালোবাসা/প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অধিকার নারীর রয়েছে।

ভালোবাসা/প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অধিকার নারীর রয়েছে।সঙ্গী নির্বাচন করা এবং সঙ্গীকে ত্যাগ করার অধিকার সকল মানুষের আছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এই স্বাধীনতা এবং অধিকারের অন্তরায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে যদি তথাকথিত ''পৌরুষে'' আঘাত লেগেছে বলে কোনো নারীকে খুন করা হয় এই দায় রাষ্ট্রের এবং সকল পুরুষের। বরাবরের মতো ছাত্রলীগ নামক এই দানব বাহিনীর পক্ষে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান সেই সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা ''অবৈধ ক্ষমতাসীনদের'' উৎখাতে শপথ নিন।

Tuesday 30 August 2016

প্রাণভিক্ষা না চাইলে যেকোনো সময় ফাঁসি কার্যকর

মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এই রায় ঘোষণার পর বিকেলেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপের ইতি ঘটল।
রিভিউ খারিজের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর এই কেন্দ্রীয় নেতার দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হলো। এখন তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তবে এই সুযোগ তিনি নেবেন কি না, তা তাঁর আইনজীবী বা পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি। প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

Saturday 20 August 2016

যুবকদের পড়নে মুজিবকোট আর জঙ্গিদের হাতে বন্দুক--সমান বিপজ্জনক।

যুবকদের পড়নে মুজিবকোট আর জঙ্গিদের হাতে বন্দুক--সমান বিপজ্জনক।
২।
আপনার হাতে সবুজ পাসপোর্ট থাকলেই কি আপনি স্বাধীন? নাগরিকের আইডি থাকলেই নাগরিক? বাড়ীর ঠিকানা বাংলাদেশে হলেই আপনার বাড়ি বাংলাদেশে?
না। আপনার সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কাজীর গোড়ূ আপনি, খাতায় আছেন, গোয়ালে নেই। আপনার নয়া মানচিত্র এঁকেছে মোদী। এখন আর পাকিস্তানী, বাংলাদেশী, পাহাড়ি বাঙালী কোণটাই নন বরং জয় হিন্দ।
৩।
হাসীনার বূক আর পেছনের কাপড় সব খূলে গেলে তার উপর দিয়েই যাচ্ছে আখাওড়া টূ কলকাতার ট্রেন। পায়ড়া বন্দর টূ মুম্বাইয়ের জাহাজ।
৪।
মীরজাফরের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে দেশপ্রেম দেখাতে হবে। নাহলে, মোদীকে সব দিয়ে দেবে। আর সে ফেরত দেবে না।
কোহিনুর ফেরত চেয়ে আদালতে হেরে গেছে দিল্লী।। কারণ ব্রিটিশ আদালত বলেছে ওরা সেটা লিখিত ভাবে পেয়েছে।
হাসিনাও যা দিচ্ছে, সব লিখিত নিচ্ছে মোদী। ওরা এত বোকা ণা। ফেরত চাইলে বলবে, হাসিনাকে বলুন। তখন কেও আর হাসীনাকে খুঁজে পাবে না। আন্দোলন চাই।

Wednesday 10 August 2016

রুটি-রুজির অবলম্বন যখন শেখ মুজিব !!!!!!!!!

রুটি-রুজির অবলম্বন যখন শেখ মুজিব !!!!!!!!!

শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেঁচে খাওয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিছু মানুষ শেখ মুজিবের 'কুখ্যাত' তত্ত্ব প্রচার করে রুটি-রুজির ব্যাবস্থা করে দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে সংসার।''মুজিব বন্দনা'' ''মুজিব পূজা'' রীতিমতো পেশা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। দুনিয়াতে এতো পেশা, কর্ম সুযোগ থাকার পরও এই মানুষগুলো কেন এই নির্লজ্জ, চাটুকারিতার পেশাকে বেঁচে নিয়েছে ? 
এই ব্যাক্তিদের মধ্যে আনিসুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, রামেন্দু মজুমদার, ডঃ আনোয়ার হোসেন, এ কে আজাদ,আরেফীন সিদ্দিক সহ প্রমুখরা উল্লেখযোগ্য।

শেখ মুজিবের 'বাকশাল' কে তারা ''বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র'', ৭৪'র দুর্ভিক্ষ ''যুদ্ধ বিধ্ধস্ত'' পরিস্থিতি, ''মুজিব -ইন্দিরা'' নামক গোলামীর চুক্তিকে ''বন্ধুত্বের'' চুক্তি বলে প্রচার করে। 'বিশিষ্ট ব্যাক্তি' 'বুদ্ধিজীবী' নামক এই ছা -পোষা শ্রেণী আওয়ামীলীগ, শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমার্থক বলে মনে করে এবং মানুষের উপর ' গাঁজাখুরি' তত্ত্বকে চাপিয়ে দিতে চায়।

শেখ মুজিবের বন্দনা না করে, বারবনিতার ''দেহ দান'', নাপিতের ''খৌর কর্ম'' করে সংসার চালানো অনেক গৌরবের, অনেক সম্মানের।

Monday 18 July 2016

সুন্দরবন ভারতকেই দিতে হবে।

সুন্দরবন ভারতকেই দিতে হবে।
তেল নেয়ার জন্য ভারতকেই আমাদের রাস্তা ব্যবহার করতে দিতে হবে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ভারতের পক্ষ নিয়ে, বেলুচিস্তান বিষয়ে মন্তব্য করতেই হবে।
উত্তর দিন, আপনি কেন নিজেকে এখনো স্বাধীন মনে করেন? সবুজ পাসপোর্ট থাকলেই কি স্বাধীন?
২।
শামিম ওসমান ঘোষণা দিয়েছে , নভেম্বরে বিশাল দুর্ঘটনা ঘটবে। আমার সন্দেহ, এবার খালেদা ফিনিশ।
৩।
আবারো রাজকোষের ৮০ কোটি টাকা বায় করে ২৫০ গুণ্ডাপাণ্ডার জাতিসংঘ সফরের খবরে শরীরে জড় উঠেছে। ভিভিয়াইপি বিমান নিয়ে হাসিনার তুঘলকি কাণ্ড আবারো দেখতে হবে? কেন? এর অত্যাচারের শেষ কোথায়?
এই টাকায় ৫০০০ মাইল বেরীবাধ, বন্যাক্রান্তদের জন্য ৬০০০০ টিনের ঘর, ২ লাখ মানুষকে ২ মাস তিন বেলা খাওয়ানো যেতো।
জাতিসংঘে আসার অর্জন জানেন?, ১ টা আর্থ পুরষ্কার , ১ টা নাড়ি উন্নতির ফাও ফাও নোবেল আর কেনেডি বিমানবন্দরে বিএনপির জুতা।
৪।
শেখ জামাল, কামাল, রাসেল, মুজিব , বঙ্গমাতার নামে খেলার মাঠগুলো দখলে রেখে, তরুণদেরকে জঙ্গি খেলায় দারুন উৎসাহ দিচ্ছে হাসিনা।
কর্মীরাও নেত্রীর আদর্শে তরুণদের ভবিষ্যতের কুলখানি করে, খেলার মাঠগুলোতে তুলছে হাইরাইজ বিল্ডিং।
৫।
ট্রাম্প না হাসিনা? হাসিনা না ইসরায়েল? কে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী জানেন? না জেনে কথা বলেন কেন?
আপনার সোনার বাংলাদেশেই সবচে বড় জায়ন হাসিনা আর তার নাৎসি বেনজিরের প্রধান কাজ, জঙ্গি অপবাদে মুসলিমদেরকে ক্রসফায়ার আর মসজিদে খুতবার জন্মনিয়ন্ত্রন।
১৫ মাসে ইসরায়েল মেরেছে ৩৫২ মুসলিম। বলেন, আপনাদের পীর সাহেবানির হাতে কয় হাজার মুসলমান খুন? ট্রাম্প এর লেজটা কি এবার ছারবেন?
যেদেশে হাসিনা আছে, সেদেশে ট্রাম্প লাগে না।
যেদেশে ছাত্রলীগ আছে, সেদেশে নাৎসি লাগে না।
প্রত্যেকদিন তার কাজ, বাংলাদেশী হত্যা করে মোদীকে খুশী করা। কারন, দেশবিভাগের জন্য বিজেপি বাঙ্গালী মুসলিমদেরকেই দোষে।

3 Bauls hacked in Chuadanga

Three veteran Bauls (Sufi artists) were hacked in their rest in Chuadanga's Jibannagar upazila in the small hours of today. Specialist says their condition is basic.

Harmed Rashida Khatun, 60, Abdur Rahim, 65, and Bulu Begum, 50, are presently experiencing treatment at neighborhood wellbeing complex, our Kushtia reporter reports.

A few Bauls were resting at their Akhra (dwelling place) at Ektarpur town when around eight to ten aggressors assaulted around midnight with sharp weapons.

Alternate Bauls figured out how to escape the spot, said Mukul Hossein, proprietor of the Akhra. "It couldn't be known who or why they assaulted the Bauls."

All the three harmed are in basic state, Dr Anisur Rahman, a specialist of Chuadanga Sadar Hospital, told The Daily Star.

Jibannagar Police Station Officer-in-Charge Humayun Kabir embraced the certainties and said he had sent powers to research into the episode.

Before, activist associations, employing the names of Islamic State and al-Qaeda in the Indian Subcontinent killed a few people who had a place with different religions.

3 Bauls hacked in Chuadanga

Three veteran Bauls (Sufi artists) were hacked in their rest in Chuadanga's Jibannagar upazila in the small hours of today. Specialist says their condition is basic.

Harmed Rashida Khatun, 60, Abdur Rahim, 65, and Bulu Begum, 50, are presently experiencing treatment at neighborhood wellbeing complex, our Kushtia reporter reports.

A few Bauls were resting at their Akhra (dwelling place) at Ektarpur town when around eight to ten aggressors assaulted around midnight with sharp weapons.

Alternate Bauls figured out how to escape the spot, said Mukul Hossein, proprietor of the Akhra. "It couldn't be known who or why they assaulted the Bauls."

All the three harmed are in basic state, Dr Anisur Rahman, a specialist of Chuadanga Sadar Hospital, told The Daily Star.

Jibannagar Police Station Officer-in-Charge Humayun Kabir embraced the certainties and said he had sent powers to research into the episode.

Before, activist associations, employing the names of Islamic State and al-Qaeda in the Indian Subcontinent killed a few people who had a place with different religions.

Friday 15 April 2016

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৫

২০১৫ সালের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কমপক্ষে ২৬২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ সবের অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫৬২টি। এ সময়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ২৪জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২৩৯জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন সংখ্যালঘু নারী যাদের মধ্যে ৯টির ক্ষেত্রে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ রয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৫ জন। তাদের মধ্যে ১০জন গণধর্ষণের শিকার, ২জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার ১জন। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ২০৯টি। এর মধ্যে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে ৬০টি পরিবার। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে ১৮০টি।
Namnlös১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত কেস ডকুমেন্টের ভিত্তিতে গত বছর সারাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র এটি। এসব ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতিকারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে বেশকিছু ঘটনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে দুষ্কৃতিকারীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় জানুয়ারি মাসে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা অন্যান্য মাস থেকে বেশি ঘটেছে। ৮৩টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। এ মাসে আক্রমণের ফলে জখম বা আহত হওয়ার ঘটনাও ছিল সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারি মাসে আর সবচেয়ে বেশি যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয় তাহলো ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা, এরূপ ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এ মাসে যশোরের স্থানীয় একজন ক্ষমতাসীন নেতার অত্যাচারে ৩১টি সংখ্যালঘু পরিবারের দেশত্যাগ এবং অন্য ৫০টি পরিবারও দেশত্যাগের পথে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে এত বেশি পরিমাণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পিছনের কারণগুলো তাহলে কী?
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনে নির্বাচন ইস্যু একটি অন্যতম বিষয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বর্তমান মহাজোট সরকারের বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি। এই নির্বাচনের ফলাফলকে বিরোধিতা করে প্রথম থেকেই বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল। ৫ জানুয়ারি থেকে তারা লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচি চলাকালে সারাদেশে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। এসময় পেট্রোল বোমার ব্যবহার ছিল অন্যতম একটি আতঙ্কিত বিষয়। তার ঠিক একবছর আগের যদি আমরা তাকাই তবে যে বিষয়টি এখনও আমাদের সামনে দগড়গে ক্ষত হয়ে আছে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই নির্বাচনে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলার মালোপাড়া সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের নারকীয় তাণ্ডব। একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পরবর্তী সময় যশোরের অভয়নগর ছাড়াও দিনাজপুর সদরের কর্ণাই, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই তাণ্ডব চালিয়েছিল নির্বাচনের বিরোধীরা। উক্ত নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে গৃহীত সরকার বিরোধী আন্দোলনেও অনুরূপভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের সংখ্যালঘুরা। এ মাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছেÑ যার পরিমাণ ৮৩টি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের আর যে অন্যতম একটি কারণ তা হলো সম্পত্তি দখল ও উচ্ছেদের তৎপরতা। যার শিকার হন সংখ্যালঘু নারী। ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসেবেও কাজ করে থাকে ভূমি দখলের অভিসন্ধি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন, উচ্ছেদ, সেই লক্ষ্যে সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয় না, রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ থেকে বের হয়ে এসে তখন লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল, উৎখাত এবং দেশত্যাগের সর্বাত্মক ব্যবস্থা সম্পন্ন করা। এরূপ উদাহরণ অনেক রয়েছে। যার একটি অন্যতম উদাহরণ গত ১৩ মার্চ, ২০১৫ সংঘটিত বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামের ঘটনা। সেখানে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা একযোগে ১৪টি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়িসহ ৪০ একর জমি দখলের তৎপরতায় নেমেছিল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে নারীদের উপর যৌন হয়রানি চলছিল এমন অভিযোগ রয়েছে। স্কুল পড়ুয়া হিন্দু মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথে উত্যক্তের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের। এমনকি এসব স্কুল পড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূদের নিয়মিত সন্ত্রাসীদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করতে হতো এমন অভিযোগও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লোকলজ্জায় এসব ঘটনা তারা কাউকে না জানিয়ে দীর্ঘদিন সহ্য করেছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উক্ত এলাকার অনেকগুলো পরিবার পৈত্রিক ভিটা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহের পরিণাম ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। এসব ঘটনা নিগ্রহের শিকার ঐ নারীকেই শুধু আতঙ্কগ্রস্ত করে না, তার পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, নিজ সমাজÑ সকলের আত্মমর্যাদা ও সম্মানের উপর প্রবলতর গ্লানি ও কালিমা লেপন করেÑ এমনটাই উপলব্ধ, অন্তত আমাদের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায়। ফলশ্রুতিতে ভুক্তভোগী পরিবারটি একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ভূমিগ্রাসীরা তাই নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ২০১৫ সালে সংখ্যালঘু নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ, এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ২৫টি (১০টি গণ-ধর্ষণ ও ২টি ধর্ষণের পর হত্যা), অপহরণ ২৪টি, অপহরণের পর ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ৯টি। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১জন।
ধর্ষণ
১. গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের বৃত্তিডাঙ্গা গ্রামে দরিদ্র এক সংখ্যালঘু পরিবারের মা ও মেয়েকে গণধর্ষণের শিকার হন।
২. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন একজন সংখ্যালঘু নারী।
৩. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাশখালীতে ২য় শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী শিশু বাড়ির পাশের দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়।
৪. ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আদিবাসী সাওঁতাল তরুণীকে অপহরণ করে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে দুই বখাটে যুবক।
৫. ৩ মে ২০১৫ রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এক আদিবাসী নারী গণধর্ষণের শিকার হন। এ সময় তার সঙ্গী অন্য এক নারীও লাঞ্ছিত হন।
৬. ১৫ মে ২০১৫ হবিগঞ্জের মাধবপুরের পল্লী রামেশ্বরের শিল্পীরানী দাস (১৮) কে ধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৭. ২১ মে ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হন একজন গারো নারী। রাতে এই ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য উক্ত নারী ও তার স্বজনদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে। শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়।
৮. ২৭ মে ২০১৫ সিলেট জেলার বালাগঞ্জে লিপন চন্দ্র দেবের স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরবর্তীতে হামলার শিকার হয় লিপন চন্দ্র দেব ও তার স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব।
৯. ৩ জুন ২০১৫ যশোরের চৌগাছা পৌর এলাকায় এক দলিত গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হন। এ সময় ধর্ষক মোবাইল ফোনে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে এবং পরে তা সিডি ও ইন্টারনেটে প্রচার করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করে উক্ত গৃহবধূ।
১০. ৫ জুন ২০১৫ রাত আনুমানিক ৯টায় সিলেটের বালাগঞ্জের অপর্ণা দাস ঘরের বাইরে টয়লেটে গেলে সেখান থেকে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা মোঃ হিরণ মিয়া ও মোঃ শফিক আলী তাকে অপহরণ করে শফিক আলীর বাড়িতে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
১১. ৯ জুলাই ২০১৫ উখিয়া উপজেলার কুতুপালং-এ অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন ইতি বড়ুয়া।
১২. ১১ জুলাই ২০১৫ নওগাঁ জেলার ধামইরহাটের গীতা রানী রবিদাসকে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে দেলোয়ার হোসাইন (৪০)।
১৩. ২৯ জুলাই ২০১৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারায় গণধর্ষণের শিকার হয় আদিবাসী তরুণী অঞ্জনা ত্রিপুরা (১৭)।
১৪. ৪ আগস্ট ও ৮ আগস্ট ২০১৫ খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে ২টি শিশু (শ্রাবন্তী বাছাড় (৮) ও (হিরা রায় (৯)) মোঃ সোহরাব গাজী নামে একই ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়।
১৫. ৪ আগস্ট ২০১৫ রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণির আদিবাসী ছাত্রী মিনিতা মারানকে নির্জন কক্ষে একা পেয়ে ধর্ষণ করে মোঃ আল আমীন (২২)।
১৬. ১৮ আগস্ট ২০১৫ বান্দারবানের আদিবাসী তরুণী সুবরন ত্রিপুরা (১৬) চিকিৎসার জন্য লামা হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে তিনি হাসপাতালের কর্মচারীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন।
১৭. ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত আনুমানিক ১১.৪৫টায় হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ জনৈক সামসুল আলম ঘরের বেড়া ভেঙে জোরপূর্বক ঘরে প্রবেশ করে রুমি রানী দাস নামে ১১ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে।
১৮. ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের ডাবুইর গ্রামে মোফাজ্জল হোসেন জিন্নাহ (৪৫) নামে যুবলীগ কর্মী বুলি রানী নামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক কিশোরীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে।
১৯. ১ নভেম্বর ২০১৫ নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ভাতগ্রাম নিবাসী এক আদিবাসী গৃহবধূ বাজারে ঝাড়– বিক্রি করতে পাশের দক্ষিণখা গ্রামে গেলে উক্ত গ্রামের সাদেকুল ইসলাম জোর করে তাকে বড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।
২০. ১১ নভেম্বর ২০১৫ বুধবার রাত ৯টার দিকে নীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের বাবুবাজার এলাকায় এক সংখ্যালঘু তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। উক্ত তরুণীর বাড়ি জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে।
২১. ২২ নভেম্বর ২০১৫ নাটোর বাগাতিপাড়ার লোকমানপুর নর্থবেঙ্গল চিনিকলের সুপারভাইজার ভবানী দাস ঘোষালের স্ত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২২. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলা মহালছড়ি উপজেলায় মাইসছড়ি ইউনিয়নে পাচ একর (রাবার বাগান) এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় মাইসছড়ি ইউনিয়নের লম্বাছড়া বাসিন্দা বীণা দেবী ত্রিপুরা (১৬)।
২৩. ডিসেম্বর ২০১৫-এ কাপ্তাই সুইডেন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বিএসপিআই) সড়কে হাঁটতে বের হলে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী কিশোরীকে একটি অটো রিকশায় চারজন লোক তুলে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে বিএসপিআই সড়কের কাছে ফেলে পালিয়ে যায়।
২৪. এছাড়া ১২ অক্টোবর ২০১৫ গাজীপুর শহরের পূবাইল সাপমারা এলাকার সান্ত¡না রবিদাস নামে ৯ বছরের দলিত শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
অপহরণ
১. ২১ জানুয়ারি ২০১৫ অপহৃত হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরবাগ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জোৎস্না বিশ্বাস।
২. ৪ মার্চ ২০১৫ নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার রায়মাধম গ্রামের শিল্পী রানী দাসকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একই গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দোস্ত মোহাম্মদ খান অপহরণ করে।
৩. ১৪ মার্চ ২০১৫, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার লেমুয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী কনা রানী ব্যাপারীকে অপহরণ করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিবাহের কাগজপত্র তৈরিসহ যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
৪. ১৭ এপ্রিল ২০১৫ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার তারাপাশা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী শ্যামলী রাণী দে (১৫) অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর তার জাল জন্ম-নিবন্ধন সনদপত্র তৈরি করে পূর্বের নাম গোপন করে নতুন নাম দিয়ে গত ১৯ এপ্রিল নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
৫. গত ২৭ মে ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় কিশোরগঞ্জের বিন্নাটি মজিদ মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী পিংকি রানী সূত্রধর।
৬. ৫ জুন ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় সিলেটের বালাগঞ্জের দেঘরিয়া গ্রামের অপর্না দাস। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য অপহরণকারী ও তাদের পরিবার তৎপরতা চালায়।
৭. ১৪ জুন ২০১৫ গোয়াইনঘাট ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী সোমা রানী দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।
৮. ২৫ জুন ২০১৫, গাজীপুর জেলার বাগের বাজার হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অন্তরা রানী দেবনাথকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে অপহরণকারী ও তার পরিবার অন্তরা রানীকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং অপহরণকারীর সাথে বিবাহের জন্য তৎপরতা চালায়।
৯. ১৩ জুলাই ২০১৫ খুলনার ডুমুরিয়ার সাহাপুর মধ্যমগ্রাম ডিগ্রি কলেজে ছাত্রী প্রিয়া সাহাকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা
১০. ৯ জুলাই ২০১৫ কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং নিবাসী ইতি বড়ুয়া অপহরণের শিকার হন।
১১. ৩০ জুলাই ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নারায়ণগঞ্জের আদমজী কলেজের ছাত্রী বৃষ্টি বিশ্বাস।
১২. ৩ আগস্ট ২০১৫ নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুস্মিতা সিংহ অপহরণের শিকার হয়। এই ঘটনায় অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৩. ২০ জুলাই ২০১৫ ভাষানটেক দেওয়ানপাড়া এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় রূপা সরকার। পরে অপহরণকারী ও তার পিতামাতা রূপাকে জোরপূর্বক এফিডেভিটের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। এরপর রূপা সরকারের পরিবার প্রশাসনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয় এবং রূপা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই গত ২৪ আগস্ট ২০১৫ পুনরায় উক্ত অপহরণকারী আবারও তাকে অপহরণ করে।
১৪. ২৮ আগস্ট ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় চট্টগ্রাম হালিশহর গরিবে নেওয়াজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী রিংকি রানী দেবনাথ।
১৫. ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় সিলেট নাসিরাবাদ বিলপাড় নিবাসী দশমী রানী দেবনাথ (১৪)।
১৬. ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রাম হাটহাজারী সদর নিবাসী রাত্রি দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।
১৭. ৮ অক্টোবর ২০১৫ কিশোরগঞ্জে পাকুন্দিয়া হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুপ্রিয়া রানী রায় অপহরণের শিকার হয়। ১০ অক্টোবর ২০১৫ তাকে জোরপূর্বক কোর্ট এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে দুর্বৃত্তরা।
১৮. ২০ অক্টোবর ২০১৫ গাইবান্ধা থেকে অপহৃত হয় ধাপের হাট প্রিয়বালা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না রানী। গত ১৩ নভেম্বর ২০১৫ কুমিল্লা থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
১৯. ৩১ অক্টোবর ২০১৫ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ইছাকুড়ি বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অষ্টমী রানী বালা।
২০. ৯ নভেম্বর ২০১৫ সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার জয়শ্রী গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী মন্টি রানী সরকারকে (১৬) অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহে বাধ্য করার অভিযোগ করে অপহৃতার পরিবার।
২১. ১৬ নভেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরিকোরা গ্রামের অরি চক্রবর্তীকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের পর অপহরণকারীরা প্রচার করতে থাকে যে মেয়েটি সেচ্ছায় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়েছে এবং বিয়ে করেছে। অপহৃতার গরিব পিতা আনোয়ারা থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়েটির পিতা চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
২২. ২৬ নভেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় টাঙ্গাইল ধনবাড়ি কলেজের ছাত্রী উপমা সাহা।
২৩. ২৯ নভেম্বর ২০১৫ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর সরিফুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রী হিরামনি অপহরণের শিকার হয়। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও বিবাহের তৎপরতা চালায় অপরণকারী ও তার সহযোগীরা।
২৪. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নোয়াখালী সৈকত ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সুমি রানী মজুমদার। গত ৯ জানুয়ারি ২০১৬ সুমির পরিবার নোয়াখালী প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুমিকে উদ্ধার ও অপহরণকারীদের শাস্তি দাবি করে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা একটি অবধারিত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় প্রতিবছর বাংলাদেশে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালে রাজধানীতে ২২৫টি সহ সারা দেশে মোট ২৮ হাজার ৯৬২টি পূজা মণ্ডপে শারদীয়া দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় এর সংখ্যা বেড়েছে ২৬২টি। ২০১৪ সালে সারাদেশে ২৮ হাজার ৭০০টি, ২০১৩ সালে ২৮ হাজার ২০০টি, ২০১২ সালে ২৭ হাজার ৮শ’টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে প্রতিবছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়লেও ভক্ত বা পূজারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী। আপাতদৃষ্টিতে তাই প্রতিবছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই। আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বীকৃতি দিলেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পারে নি। ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উপর উপর্যুপরি এই হামলার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক যে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা কিংবা তা কার্যকরের সময়েও হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। বিগত ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে নি, বরং তা প্রায় প্রতি বছরই থেকেছে উদ্বেগজনক। প্রতিবছর সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরেরও মহোৎসব শুরু হয়। যা পুরো শারদীয়া দুর্গা উৎসবের যেন এক চিরায়ত কলঙ্কময় অধ্যায়। স্বাধীনতার পর এতোগুলো বছর অতিক্রান্ত হলেও এই কলঙ্ক থেকে এখনো মুক্ত হতে পারে নি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণের বাংলাদেশ। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে উল্লেখযোগ্য হারে ঘটে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। ২০১৫ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসময় দুর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা কালী পূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেকারণে প্রতিমা ভাঙচুর সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও এসময় বেশি ঘটে থাকে। ২০১৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ৩৬টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
পূজার মৌসুম ছাড়াও প্রায় সারা বছরই প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু ডিসেম্বরে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুরের তথ্য উল্লেখ করতে চাই যে মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো পূজার মহোৎসব ছিল না। ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২১টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।
১. ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌরসভার শহরগাছী এলাকায় চন্দনা পাহাড়ী (৩২) নামের এক আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কাজিরবন কালী মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
২. ৫ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার পর্যটন কেন্দ্র দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউর মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে দুর্বৃত্তের ছোড়া হাতবোমা বিস্ফোরণে আহত হন ৯জন।
৩. ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবরশাহ থানাধীন নিউ শহীদ লেন এলাকায় শ্রীশ্রীশ্যামাকালী বাড়ির মন্দিরে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়। এ সময় মন্দিরের আসবাবপত্র ও অন্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়। এতে ৬ জন আহত হয়।
৪. ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ডাবোর ইউনিয়নের জয়নন্দ ডহচি গ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে গুলি ও বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। রাত সোয়া ৮টার দিকে মন্দিরে কীর্তন ও ধর্মসভা চলার সময় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধসহ চারজন আহত হয়।
৫. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রকাশ্যে শিব মন্দিরে হামলা ও ৩টি প্রতিমা ভাঙচুর করে স্থানীয় প্রভাবশালী কলিমুদ্দিন গং। হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানোর কারণে অনেকেই তাদের জমি ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন।
৬. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি গ্রামের উত্তর পাড়া সার্বজনীন মনসা মন্দিরে মনসা মূর্তি ও একই গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের রাধা গোবিন্দ মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
৭. ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের শত বছরের পুরোনো সার্বজনীন কালীমন্দিরের ৭টি প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
৮. ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ রোববার সকালে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় বাউসী বাঙ্গালীপাড়া পদ্মা পূজা মন্দিরের পদ্মা প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
৯. ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ সোমবার রাতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের মহেষপুর গোপপাড়া গ্রামে সার্বজনীন কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে শীতলা মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
১০. ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামের রৌমারীতে উপজেলার নমদাসপাড়া গ্রামে মন্দিরের কালী, লক্ষ্মী ও শিবের মূর্তি ভাঙচুর করে।
১১.২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মির্জাবাড়ি বাজারের কাছে দড়িহাসিল এলাকার মাখন লাল গোপ ও সুবল চন্দ্র গোপের বাড়ির দুটি পারিবারিক কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য একটি উদ্বেগজনক বার্তা। এদেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের পেছনের অন্যতম একটি কারণ এটি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ত্যাগ করে থাকেন। তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে ব্যবসা, বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও মামলার হুমকিসহ হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটে থাকে, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যে কারণে নিরাপত্তাহীন অসহায় পরিবারগুলো বাপ-দাদাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্মভিটা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, রাষ্ট্র এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে কখনও দেখছে না। বরং কখনও কখনও রাষ্ট্রের মন্ত্রী, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় এই হামলার খবর প্রকাশিত হলেও কোনোটির আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি বরং হয়রানির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তাদের যেন এই জায়গাটিতে একটি দৃশ্যমান মিল পরিলক্ষিত হয়। একদিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে এই সব হামলা ও নির্যাতনের বিচার হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। সরকারদলীয় কেউ এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে সেক্ষেত্রে বিচারের প্রত্যাশা আরও ক্ষীণ। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
২৮ অক্টোবর ২০১৫ বুধবার রাতে চাঁদা না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা জেলেপাড়ায় হামলা চালায় আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডাররা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ও পেটের সন্তান। তার পেটে উপর্যুপরি লাথির চোটে ঘটনাস্থলেই মৃত বাচ্চা প্রসব করেন তিনি। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় শিশুটির। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও মারধরে গুরুতর আহত গৃহবধূ তুলসী রানী দাসকে আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- আলোরানী দাস, জহরলাল দাস, শোভারানী দাস, বিকাশ, শুকদেব দাস ও পরিমল দাস। প্রায় ২২-২৫ জনের হামলাকারী দলটি জেলেপাড়ার ঘরবাড়িগুলোতে আচমকা ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করে। প্রতিবন্ধী স্বপন দাসের দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় তারা। এ সময় তাদের ঠেকাতে পাড়ার লোকজন এগিয়ে এলে ক্যাডাররা নিরীহ সংখ্যালঘুদের মারধর শুরু করে। হামলাকারীদের হাত থেকে আহত রবীন্দ্রদাসকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন তার ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তুলসী রানী দাস। এ সময় হামলাকারীরা তুলসীর তলপেট ও কোমরে উপর্যুপরি লাথি মারে। লাঠি দিয়েও তাকে মারধর করে। মুহূর্তেই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি। পরদিন সকালে আহত তুলসীকে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে প্রায় অর্ধশত পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে নৌকায় ছোট ফেনী নদীতে আশ্রয় নেন। পরে রাত সাড়ে ৯টায় পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে জেলে পরিবারগুলো নদী থেকে বাড়ি ফিরে আসে। আর আহতরা রাতে পুলিশের সহযোগিতায় ফেনী সদর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এই ঘটনার কোনো বিচার এখনও হয় নি।
সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিপীড়নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। চাঁদা না পেয়ে ৯ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার মধ্যরাতে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়ার পালপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এতে আহত হয় ৮ জন। ধলিয়া ইউনিয়নের বালুয়া চৌমুহনীর পালপাড়া গ্রামের গোপাল পালের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিল এসকল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। ৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ৭-৮ জন সহযোগী নিয়ে গোপাল পালের বাড়িতে হামলা করে এবং দেশীয় বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দেয়। বাড়ির লোকেরা বাধা দিলে উক্ত ছাত্রলীগ নেতার পিতা স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি তার সহযোগীদের নিয়ে দেশীয় বন্দুক, কিরিচ ও রামদা নিয়ে তাদের ওপর আরেক দফা হামলা করে। বিমল পাল ও গোপালসহ ৮জন আহত হয়। ৯ ডিসেম্বর বুধবার বিকেলে ফেনী মডেল থানায় মামলা করা হলে সন্ত্রাসীরা বুধবার মধ্যরাতে আবারও সশস্ত্র অবস্থায় হাজির হয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দেয়। এ সময় তারা বাড়ির আঙিনায় ৪টি খড়ের গাদায় আগুন দেয়। এরপর আতঙ্কে পালাপাড়ার কয়েকটি বাড়ির লোকজন পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের দায়ের করা অভিযোগ মামলা আকারে গ্রহণ করতে থানা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন না এমন অভিযোগও বিস্তর রয়েছে। গত ডিসেম্বরে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে পটুয়াখালীতে। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপেজলার আলীপুর গ্রামের ২টি সংখ্যালঘু পরিবারের ১২জন সদস্যকে হত্যার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এক প্রভাবশালী। সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে উক্ত ২ পরিবারের মধ্যে ১টি পরিবারের প্রধানকে গত ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ অপহরণ করে তারা। পরিবারের সদস্যরা অপহরণ মামলা করতে গেলে কলাপাড়া থানার পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা নেয় নি। এরপর ভুক্তভোগী পরিবার উক্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে মামলা করলে আদালত অভিযুক্তদের তলব করেন। এর পর থেকেই প্রভাবশালী মহল উক্ত পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। এভাবে প্রভাবশালীরা সারাদেশে হিন্দুদের ভিটেমাটি দখল করে তাদের নিঃস্ব করছে। বাধ্য হয়ে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করছে। এসকল প্রভাবশালীদের মদদ দিচ্ছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই ঘটনায় ওসি অপহরণের মামলা না নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে যে এসকল ভূমি-দস্যুকে প্রশাসন কোন না কোনভাবে সহায়তা করছে। বেশিরভাগ ভূমি-দস্যুই ক্ষমতাসীন দলের। তারা হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। এদের ক্ষমতা এবং দাপটের কাছে অসহায় হয়ে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয় হিন্দু পরিবারগুলো। যারা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, তারা নিজেরাই উল্টো অত্যাচারীদের মদদ দেয়। প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকায় এ ধরনের খবর পাওয়া যায়। ভূমি-দস্যু এবং দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার খবর সেই তুলনায় নেই বললেই চলে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে দখলবাজি আরও বেড়ে যায়। যদি একের পর এক হিন্দুদের ভিটেমাটি দখল করে ঘরছাড়া করা হয় তাহলে এক সময় দেশে হিন্দু সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতার আরও ১টি অভিযোগ উঠেছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ৫৫ হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের তৎপরতা বন্ধের দাবিতে গত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতার ভূমিদস্যুরা ৫৫টি সংখ্যালঘু পরিবারের সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ওপর নানা উপায়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের চন্ডিপুর ইউনিয়নে ৭ পুরুষ ধরে পরিবারগুলো বাস করে আসছে। তাদের জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২৫ একর। এ জমিতে বসতভিটা ছাড়াও রয়েছে আবাদি জমি ও মন্দির। ভূমিদস্যুরা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ও সন্ত্রাসী দিয়ে হয়রানি, মারধরের মাধ্যমে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করার চেষ্টা করছে। সংখ্যালঘু হওয়ার সুযোগে তাদের পুড়িয়ে হত্যা, স্ত্রী-মেয়েদের ধর্ষণ ও দেশ থেকে তাড়ানোর হুমকি দিচ্ছে। তাদের ভয়ে সংখ্যালঘুরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসন তাদের কোনো সহায়তা করছে না। যদি কোনো সমাধান না হয় তাহলে তাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানান তারা।
এ জাতীয় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই যেটি ঘটেছে নওগাঁর মহাদেবপুরে। সেখানে উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের চাহিদামত ঘুষ দিতে না পারায় এক সংখ্যালঘুর ৩২ বছর ধরে দখলে থাকা সম্পত্তি অন্যের নামে লিজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভিপি সম্পত্তি লিজের ক্ষেত্রে লিজ গ্রহীতার অগ্রাধিকারের বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে সে বিধান মানা হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়। এদিকে নতুন লিজ গ্রহীতা জমি দখল নিয়ে উক্ত সংখ্যালঘু পরিবারটিকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে এবং প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছে। এছাড়াপ্রায় ৫শত হিন্দু পরিবারের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জের মাহমুদপুরের মাতবর এ্যাগ্রো ফিশারিজের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জে হিন্দু অধ্যুষিত মাহমুদপুর বিলে জোর করে মৎস্য প্রজেক্ট করার মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছে উক্ত মাতবর এ্যাগ্রো ফিশারিজ। এখানে এ প্রকল্প হলে গ্রামের অন্তত ৫ শ’ হিন্দু কৃষি পরিবার তাদের পেশা হারাবেন। গ্রামের হিন্দুদের জমি ফিশারিজের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
২০১৫ সালে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ২৪ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৩৯জন। গুরুতর হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ফরিদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অলোক সেন। ২৪ নভেম্বর ২০১৫ তাকে ফরিদপুর শহরের নিজ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত করে কতিপয় মুখোশধারী সন্ত্রাসী। অলোক সেন ফরিদপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। এছাড়া ৫ অক্টোবর ২০১৫ সকালে বাসায় ঢুকে পাবনার ঈশ্বরদীর ফেইথ বাইবেল চার্চের যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তিন যুবক। বেশ কয়েকজন যাজককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। রংপুরের ১জন খ্রিস্টান ফাদার ও বিভিন্ন চার্চে কর্মরত আরও ৯জন পাদ্রিকে ডাকযোগে পাঠানো চিঠির মারফত হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ আঞ্চলিক ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ রংপুরের পালক প্রধানের নামে হত্যার হুমকি সংবলিত চিঠি আসে গত ২৫ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে। এ ছাড়াও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ক্যাথলিক মিশনের ফাদারকে হত্যার হুমকি দেয় দুর্বৃত্তরা। খুলনাতেও খ্রিস্টান ধর্মীয় যাজকদের উপর হত্যার হুমকি আসে এ মাসে। ২৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুরে মোবাইল ফোন মারফৎ বাংলাদেশ ইন্টারচার্চ পাস্টরস এন্ড লিডারস ফেলোশিপের খুলনা বিভাগের নির্বাহী সচিব এবং চার্চ অব গড এর বাংলাদেশ প্রধানসহ খুলনা বিভাগ ক্যাথলিক চার্চের বিশপকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ বছর মোট ৫২টি হত্যার হুমকির খবর জানা গেছে। শুধু ডিসেম্বরে বড়দিন উদাযাপনের পূর্বে দুইজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকসহ সারাদেশে ৩৭জন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীকে হত্যার হুমকি আসে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের নেতৃত্বে সকল হিন্দু সংগঠন নিষিদ্ধের দাবি এবং তার প্রেক্ষিতে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের কঠোর প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি এদেশের হিন্দুদের মধ্যে সংশয়ের জন্ম দেয়। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ ও সমমনা ১৩টি সংগঠন বাংলাদেশের সকল হিন্দু সংগঠন নিষিদ্ধের দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। এসব দাবির মধ্যে ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নিষিদ্ধ ঘোষণা, জাগো হিন্দু পরিষদ, ইসকন, হিন্দু মহাজোট, বেদান্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সনাতন মৈত্রী সংঘ, আর্য সমাজের কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণার দাবি প্রভৃতি।
আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ সুবিধা পাবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, গোষ্ঠী, বা সম্প্রদায় যা-ই হোক না কেন, আইন যেমন সবার জন্য সমান হবে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, উৎসব করার স্বাধীনতা সবার বেলায় সমান হবে। এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না এটাই প্রতিটি নাগরিকের কাম্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আশানুরূপ নয়। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সামাজিক অনুশাসনে বহুত্ববাদের (Pluralism) স্বীকৃতি ও চর্চার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এদেশের সংখ্যালঘুরা নিজদেশেই ঐতিহাসিক কাল ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবহেলা ও বঞ্চনা শিকার হচ্ছেন। তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। প্রতিনিয়ত তাদেরকে নিজেদের আবাস থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। এথনিক ক্লিনজিং-এর যে চর্চা দূর অতীত থেকে এই ভূখণ্ডে চলে এসেছে আজও তা অব্যাহত রয়েছে। এদেশে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী কালক্রমে আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃক ধর্মকে ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকীকরণের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছেন, বেড়েছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর ধারনা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাকে অকার্যকর করেছে, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, প্রকৃতি পূজারী নির্বিশেষে সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা ও সম্পত্তি দখল, মন্দির, প্রতিমা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গ্রন্থ প্রভৃতি ধ্বংস করে এ প্রক্রিয়াকে সহায়তা যোগাচ্ছে। আমরা চাই এক্ষেত্রে রাষ্ট্র হবে আরও মানবিক। সকল সম্প্রদায়ের ও ধর্মীয় মতাদর্শের জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে আজকের বাংলাদেশ।

Saturday 19 March 2016

কালের অনুধ্যান

কুসংস্কার থেকে না মুক্তচিন্তা থেকে ওয়াক আউট?
আমরা সবাই জানি যে, গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ থেকে বিরোধী সাংসদরা সরকারী দলের সাথে মতামতে না মিললে মাঝে মাঝে ওয়াক আউট করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন, কখনও বর্জন করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন। তবে লম্বা সময় ধরে সংসদের বাইরে থাকেন না। আমাদের দেশে নিজের সাংসদ পদ বহাল রাখার জন্য যে সময়টুকু আইনী প্যাঁচে থাকা দরকার এর বেশি সংসদে থাকেন না।
তেমনি, সংস্কার, কুসংস্কার,নাস্তিক ও আস্তিকের বিষয়টিও অনেকের মনে এমনই দোলাচলে দোলায়িত। স্বার্থ, সময় ও সুযোগ বুঝে মুক্তচিন্তায় প্রবেশ করেন, মুক্তচিন্তা থেকে ওয়াক আউট করেন, মুক্তচিন্তায় অংশগ্রহণ করেন।
অন্যভাবে বলা যায়, সময় বুঝে কুসংস্কার থেকে ওয়াক আউট করেন, কুসংস্কার বর্জন করেন, আবার কুসংস্কারে বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বুঁদ হয়ে থাকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে তা আমার পর্যবেক্ষনের রাডারে ধরা পড়ছে না। কারণ আমাদের রঙ বদলানো চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। ওয়াক আউটের নীতিহীনতা। যেমন, বামপন্থীদের হজ্বব্রত পালন।
শৈশবে দেখতাম পঞ্জিকা দেখে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করা হত । দিনে না মিললে বলা হইতো বুধবার যাত্রা শুভ। অথবা ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা সেই সমকে বলে উষা এবং নিদেনপক্ষে যে কোনদিন ঐ সময়ে যাত্রা করা শুভ। আর যাত্রা বলতে বড় জোর মামার বাড়ী যাওয়া। বউদের বাপের বাড়ি যাওয়া। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া।। পড়তে শহরে যাওয়া।
আবার এক ঘর থেকে ছেলের বউ ও মেয়ে একদিনে যেতে দিত না। এখনও আমি আমার বাপের বাড়ি নরসিংদী গেলে কোন কোন পরিবারে দেখি বা শুনি, না আজ মেয়ের যাওয়া উচিত না। বউ গেল। কাজেই মেয়ে খুশিতে ডগমগ, কিন্তু মেয়ের জামাইয়ের রাগারাগি। এ নিয়ম মানতে ও মানাতে গিয়ে অশান্তি।জামাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ওয়াক আউট করার ঘটনার অঢেল উদাহরণ বিরাজমান।
বা আজ মেয়ে গেল। কাজেই বউ কাল যাবে। এদিকে বউয়ের গাল ফোলা। একদিন আগে বাপের বাড়ি যেতে পারল না। অসন্তোষ।বিক্ষোভও হয়।পাতিল ভাঙ্গার ঘটনাও নজিরবিহীন না।
অন্যদিকে, ভিসা পেলে প্লেনের টিকিট কাট। টিকিট আবার সস্তাটা খোঁজো বা উপো্যগী রুট খোঁজ কিংবা ট্রানজিটে সময় কম লাগে খোঁজ। অথবা, এক দেশে যেতে ট্রানজিটে আরেক দেশ দেখার সুযোগ খোঁজ। ভর্তির বা ক্লাস শুরুর তারিখ বা চাকরিতে যোগদানের সময় দেখে যাবার তারিখ ঠিক কর। কোথায় গেল পঞ্জিকা আর কোথায়ই বা শুভ দিনের গণনা! এক্ষেত্রে আমার মায়ের যুক্তি ছিল–মাসের ত্রিশ দিনই ভগবানের। এটা কি আস্তিকতা থেকে নাস্তিকতার দিকে যাত্রা নয়? আর প্রয়োজন, সময়ের চাহিদা, সমসাময়িক পরিস্থিতি কি মানুষকে অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শক্তি যোগায় না? যোগায়।
এ অমোঘ সত্যটি আমরা কেউ কেউ মানি না। কেউ কেউ নিজে তো মানি ই না, অন্যে যাতে না মানে এর জন্য চাপাতি নিয়ে সদা প্রস্তুত। দিনে পাঁচবার অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে জানান দেয়। আবার অন্য গোষ্ঠি তাদের বিশ্বস্ত অলৌকিক শক্তির কথা বলতে গেলে এরা আগুনে তাদের ঘর পোড়ায়। এ সদা প্রস্তুত মূর্খদের নিয়ে সরকার ভীত বা রাজনৈতিক খেলায় মত্ত, সাধারণ জনপদ সন্ত্রস্ত, মডারেটরা আহ্বলাদিত, পরহেজগাররা গর্বিত। আর? আর! নাস্তিকেরা তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত। তবে তীক্ষ্ণ যুক্তি নিয়ে। অকাট্য প্রমান দিয়ে। চাপাতি পার্টির সে ক্ষমতা নেই। তাদের যুক্তির ধার নেই, তবে চাপাতির ধার আছে।
২০১৪ সালে আমার চট্টগ্রামের বাসার রান্না ঘরে পাখির পায়খানাসহ খড়কুটোর আবর্জনায় ভরপুর। ঢাকা থেকে লম্বা ছুটি কাটিয়ে ভোরবেলা ঘরে ঢুকে তো এক মহা অস্বস্তিতে। বুঝতে পারছি না কোত্থেকে এসব এলো। পরে আবিষ্কার করলাম রান্না ঘরের এক্সজস্টেড পাখার নিচে জালালী কবুতরের বাসা।
বিল্ডিং এর কেয়ার টেকারকে বললাম একটা ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এটা নাকি সৌভাগ্যের লক্ষণ।গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকার আমার সৌভাগ্য নিয়ে আপ্লুত।ছোটবালায় দেখেছি দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের কাঠের দোতালার বারান্দায় জালালী কবুতরের বাসা। পায়খানা করে বারান্দা ভরিয়ে রাখত তবুও তাড়াতো না। এ জাতের কবুতরের বাচ্চা খাওয়াও যায় না। অথচ তাদের জন্য আমার ঠাকুমা, বোন ও কাকারা খাবার ছড়িয়ে রাখতেন।
আমার চট্টগ্রামের বাসা থেকে যেন না তাড়াই সে জন্য গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকারের বলিষ্ঠ্য অনুরোধ ও পরামর্শ। এক্সজস্টেড পাখার ফাঁকে আমার সৌভাগ্যের স্থায়িত্বের জন্য নয়, কবুতরের দুটো বাচ্চা হয়েছে জেনে তাড়াইনি।পরে পর পর কয়েকদিন রান্না ঘরে ময়লা আবর্জনা সইতে না পেরে কবুতরের বাচ্চা দুটোকে বারান্দায় স্থানান্তরিত করি।। অবশেষে কবুতর নিজেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় আমার তথাকথিত সৌভাগ্যের পাখায় ভর করে। কারণ, জালালী কবুতর অন্যত্র চলে যাওয়াতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে। বাসায় ফিরে কবুতরের পায়খানাসহ আবর্জনার জঞ্জাল পরিস্কারের দায় থেকে মুক্তি মিলেছিলো।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৫

২০১৫ সালের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কমপক্ষে ২৬২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ সবের অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫৬২টি। এ সময়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ২৪জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২৩৯জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন সংখ্যালঘু নারী যাদের মধ্যে ৯টির ক্ষেত্রে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ রয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৫ জন। তাদের মধ্যে ১০জন গণধর্ষণের শিকার, ২জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার ১জন। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ২০৯টি। এর মধ্যে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে ৬০টি পরিবার। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে ১৮০টি।
Namnlös১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত কেস ডকুমেন্টের ভিত্তিতে গত বছর সারাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র এটি। এসব ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতিকারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে বেশকিছু ঘটনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে দুষ্কৃতিকারীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় জানুয়ারি মাসে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা অন্যান্য মাস থেকে বেশি ঘটেছে। ৮৩টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। এ মাসে আক্রমণের ফলে জখম বা আহত হওয়ার ঘটনাও ছিল সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারি মাসে আর সবচেয়ে বেশি যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয় তাহলো ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা, এরূপ ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এ মাসে যশোরের স্থানীয় একজন ক্ষমতাসীন নেতার অত্যাচারে ৩১টি সংখ্যালঘু পরিবারের দেশত্যাগ এবং অন্য ৫০টি পরিবারও দেশত্যাগের পথে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে এত বেশি পরিমাণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পিছনের কারণগুলো তাহলে কী?
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনে নির্বাচন ইস্যু একটি অন্যতম বিষয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বর্তমান মহাজোট সরকারের বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি। এই নির্বাচনের ফলাফলকে বিরোধিতা করে প্রথম থেকেই বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল। ৫ জানুয়ারি থেকে তারা লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচি চলাকালে সারাদেশে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। এসময় পেট্রোল বোমার ব্যবহার ছিল অন্যতম একটি আতঙ্কিত বিষয়। তার ঠিক একবছর আগের যদি আমরা তাকাই তবে যে বিষয়টি এখনও আমাদের সামনে দগড়গে ক্ষত হয়ে আছে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই নির্বাচনে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলার মালোপাড়া সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের নারকীয় তাণ্ডব। একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পরবর্তী সময় যশোরের অভয়নগর ছাড়াও দিনাজপুর সদরের কর্ণাই, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই তাণ্ডব চালিয়েছিল নির্বাচনের বিরোধীরা। উক্ত নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে গৃহীত সরকার বিরোধী আন্দোলনেও অনুরূপভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের সংখ্যালঘুরা। এ মাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছেÑ যার পরিমাণ ৮৩টি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের আর যে অন্যতম একটি কারণ তা হলো সম্পত্তি দখল ও উচ্ছেদের তৎপরতা। যার শিকার হন সংখ্যালঘু নারী। ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসেবেও কাজ করে থাকে ভূমি দখলের অভিসন্ধি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন, উচ্ছেদ, সেই লক্ষ্যে সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয় না, রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ থেকে বের হয়ে এসে তখন লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল, উৎখাত এবং দেশত্যাগের সর্বাত্মক ব্যবস্থা সম্পন্ন করা। এরূপ উদাহরণ অনেক রয়েছে। যার একটি অন্যতম উদাহরণ গত ১৩ মার্চ, ২০১৫ সংঘটিত বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামের ঘটনা। সেখানে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা একযোগে ১৪টি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়িসহ ৪০ একর জমি দখলের তৎপরতায় নেমেছিল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে নারীদের উপর যৌন হয়রানি চলছিল এমন অভিযোগ রয়েছে। স্কুল পড়ুয়া হিন্দু মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথে উত্যক্তের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের। এমনকি এসব স্কুল পড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূদের নিয়মিত সন্ত্রাসীদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করতে হতো এমন অভিযোগও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লোকলজ্জায় এসব ঘটনা তারা কাউকে না জানিয়ে দীর্ঘদিন সহ্য করেছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উক্ত এলাকার অনেকগুলো পরিবার পৈত্রিক ভিটা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহের পরিণাম ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। এসব ঘটনা নিগ্রহের শিকার ঐ নারীকেই শুধু আতঙ্কগ্রস্ত করে না, তার পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, নিজ সমাজÑ সকলের আত্মমর্যাদা ও সম্মানের উপর প্রবলতর গ্লানি ও কালিমা লেপন করেÑ এমনটাই উপলব্ধ, অন্তত আমাদের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায়। ফলশ্রুতিতে ভুক্তভোগী পরিবারটি একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ভূমিগ্রাসীরা তাই নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ২০১৫ সালে সংখ্যালঘু নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ, এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ২৫টি (১০টি গণ-ধর্ষণ ও ২টি ধর্ষণের পর হত্যা), অপহরণ ২৪টি, অপহরণের পর ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ৯টি। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১জন।
ধর্ষণ
১. গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের বৃত্তিডাঙ্গা গ্রামে দরিদ্র এক সংখ্যালঘু পরিবারের মা ও মেয়েকে গণধর্ষণের শিকার হন।
২. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন একজন সংখ্যালঘু নারী।
৩. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাশখালীতে ২য় শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী শিশু বাড়ির পাশের দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়।
৪. ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আদিবাসী সাওঁতাল তরুণীকে অপহরণ করে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে দুই বখাটে যুবক।
৫. ৩ মে ২০১৫ রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এক আদিবাসী নারী গণধর্ষণের শিকার হন। এ সময় তার সঙ্গী অন্য এক নারীও লাঞ্ছিত হন।
৬. ১৫ মে ২০১৫ হবিগঞ্জের মাধবপুরের পল্লী রামেশ্বরের শিল্পীরানী দাস (১৮) কে ধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৭. ২১ মে ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হন একজন গারো নারী। রাতে এই ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য উক্ত নারী ও তার স্বজনদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে। শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়।
৮. ২৭ মে ২০১৫ সিলেট জেলার বালাগঞ্জে লিপন চন্দ্র দেবের স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরবর্তীতে হামলার শিকার হয় লিপন চন্দ্র দেব ও তার স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব।
৯. ৩ জুন ২০১৫ যশোরের চৌগাছা পৌর এলাকায় এক দলিত গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হন। এ সময় ধর্ষক মোবাইল ফোনে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে এবং পরে তা সিডি ও ইন্টারনেটে প্রচার করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করে উক্ত গৃহবধূ।
১০. ৫ জুন ২০১৫ রাত আনুমানিক ৯টায় সিলেটের বালাগঞ্জের অপর্ণা দাস ঘরের বাইরে টয়লেটে গেলে সেখান থেকে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা মোঃ হিরণ মিয়া ও মোঃ শফিক আলী তাকে অপহরণ করে শফিক আলীর বাড়িতে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
১১. ৯ জুলাই ২০১৫ উখিয়া উপজেলার কুতুপালং-এ অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন ইতি বড়ুয়া।
১২. ১১ জুলাই ২০১৫ নওগাঁ জেলার ধামইরহাটের গীতা রানী রবিদাসকে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে দেলোয়ার হোসাইন (৪০)।
১৩. ২৯ জুলাই ২০১৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারায় গণধর্ষণের শিকার হয় আদিবাসী তরুণী অঞ্জনা ত্রিপুরা (১৭)।
১৪. ৪ আগস্ট ও ৮ আগস্ট ২০১৫ খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে ২টি শিশু (শ্রাবন্তী বাছাড় (৮) ও (হিরা রায় (৯)) মোঃ সোহরাব গাজী নামে একই ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়।
১৫. ৪ আগস্ট ২০১৫ রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণির আদিবাসী ছাত্রী মিনিতা মারানকে নির্জন কক্ষে একা পেয়ে ধর্ষণ করে মোঃ আল আমীন (২২)।
১৬. ১৮ আগস্ট ২০১৫ বান্দারবানের আদিবাসী তরুণী সুবরন ত্রিপুরা (১৬) চিকিৎসার জন্য লামা হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে তিনি হাসপাতালের কর্মচারীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন।
১৭. ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত আনুমানিক ১১.৪৫টায় হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ জনৈক সামসুল আলম ঘরের বেড়া ভেঙে জোরপূর্বক ঘরে প্রবেশ করে রুমি রানী দাস নামে ১১ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে।
১৮. ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের ডাবুইর গ্রামে মোফাজ্জল হোসেন জিন্নাহ (৪৫) নামে যুবলীগ কর্মী বুলি রানী নামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক কিশোরীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে।
১৯. ১ নভেম্বর ২০১৫ নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ভাতগ্রাম নিবাসী এক আদিবাসী গৃহবধূ বাজারে ঝাড়– বিক্রি করতে পাশের দক্ষিণখা গ্রামে গেলে উক্ত গ্রামের সাদেকুল ইসলাম জোর করে তাকে বড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।
২০. ১১ নভেম্বর ২০১৫ বুধবার রাত ৯টার দিকে নীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের বাবুবাজার এলাকায় এক সংখ্যালঘু তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। উক্ত তরুণীর বাড়ি জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে।
২১. ২২ নভেম্বর ২০১৫ নাটোর বাগাতিপাড়ার লোকমানপুর নর্থবেঙ্গল চিনিকলের সুপারভাইজার ভবানী দাস ঘোষালের স্ত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২২. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলা মহালছড়ি উপজেলায় মাইসছড়ি ইউনিয়নে পাচ একর (রাবার বাগান) এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় মাইসছড়ি ইউনিয়নের লম্বাছড়া বাসিন্দা বীণা দেবী ত্রিপুরা (১৬)।
২৩. ডিসেম্বর ২০১৫-এ কাপ্তাই সুইডেন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বিএসপিআই) সড়কে হাঁটতে বের হলে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী কিশোরীকে একটি অটো রিকশায় চারজন লোক তুলে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে বিএসপিআই সড়কের কাছে ফেলে পালিয়ে যায়।
২৪. এছাড়া ১২ অক্টোবর ২০১৫ গাজীপুর শহরের পূবাইল সাপমারা এলাকার সান্ত¡না রবিদাস নামে ৯ বছরের দলিত শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
অপহরণ
১. ২১ জানুয়ারি ২০১৫ অপহৃত হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরবাগ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জোৎস্না বিশ্বাস।
২. ৪ মার্চ ২০১৫ নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার রায়মাধম গ্রামের শিল্পী রানী দাসকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একই গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দোস্ত মোহাম্মদ খান অপহরণ করে।
৩. ১৪ মার্চ ২০১৫, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার লেমুয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী কনা রানী ব্যাপারীকে অপহরণ করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিবাহের কাগজপত্র তৈরিসহ যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
৪. ১৭ এপ্রিল ২০১৫ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার তারাপাশা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী শ্যামলী রাণী দে (১৫) অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর তার জাল জন্ম-নিবন্ধন সনদপত্র তৈরি করে পূর্বের নাম গোপন করে নতুন নাম দিয়ে গত ১৯ এপ্রিল নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
৫. গত ২৭ মে ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় কিশোরগঞ্জের বিন্নাটি মজিদ মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী পিংকি রানী সূত্রধর।
৬. ৫ জুন ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় সিলেটের বালাগঞ্জের দেঘরিয়া গ্রামের অপর্না দাস। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য অপহরণকারী ও তাদের পরিবার তৎপরতা চালায়।
৭. ১৪ জুন ২০১৫ গোয়াইনঘাট ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী সোমা রানী দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।
৮. ২৫ জুন ২০১৫, গাজীপুর জেলার বাগের বাজার হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অন্তরা রানী দেবনাথকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে অপহরণকারী ও তার পরিবার অন্তরা রানীকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং অপহরণকারীর সাথে বিবাহের জন্য তৎপরতা চালায়।
৯. ১৩ জুলাই ২০১৫ খুলনার ডুমুরিয়ার সাহাপুর মধ্যমগ্রাম ডিগ্রি কলেজে ছাত্রী প্রিয়া সাহাকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা
১০. ৯ জুলাই ২০১৫ কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং নিবাসী ইতি বড়ুয়া অপহরণের শিকার হন।
১১. ৩০ জুলাই ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নারায়ণগঞ্জের আদমজী কলেজের ছাত্রী বৃষ্টি বিশ্বাস।
১২. ৩ আগস্ট ২০১৫ নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুস্মিতা সিংহ অপহরণের শিকার হয়। এই ঘটনায় অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৩. ২০ জুলাই ২০১৫ ভাষানটেক দেওয়ানপাড়া এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় রূপা সরকার। পরে অপহরণকারী ও তার পিতামাতা রূপাকে জোরপূর্বক এফিডেভিটের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। এরপর রূপা সরকারের পরিবার প্রশাসনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয় এবং রূপা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই গত ২৪ আগস্ট ২০১৫ পুনরায় উক্ত অপহরণকারী আবারও তাকে অপহরণ করে।
১৪. ২৮ আগস্ট ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় চট্টগ্রাম হালিশহর গরিবে নেওয়াজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী রিংকি রানী দেবনাথ।
১৫. ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় সিলেট নাসিরাবাদ বিলপাড় নিবাসী দশমী রানী দেবনাথ (১৪)।
১৬. ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রাম হাটহাজারী সদর নিবাসী রাত্রি দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।
১৭. ৮ অক্টোবর ২০১৫ কিশোরগঞ্জে পাকুন্দিয়া হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুপ্রিয়া রানী রায় অপহরণের শিকার হয়। ১০ অক্টোবর ২০১৫ তাকে জোরপূর্বক কোর্ট এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে দুর্বৃত্তরা।
১৮. ২০ অক্টোবর ২০১৫ গাইবান্ধা থেকে অপহৃত হয় ধাপের হাট প্রিয়বালা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না রানী। গত ১৩ নভেম্বর ২০১৫ কুমিল্লা থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
১৯. ৩১ অক্টোবর ২০১৫ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ইছাকুড়ি বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অষ্টমী রানী বালা।
২০. ৯ নভেম্বর ২০১৫ সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার জয়শ্রী গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী মন্টি রানী সরকারকে (১৬) অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহে বাধ্য করার অভিযোগ করে অপহৃতার পরিবার।
২১. ১৬ নভেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরিকোরা গ্রামের অরি চক্রবর্তীকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের পর অপহরণকারীরা প্রচার করতে থাকে যে মেয়েটি সেচ্ছায় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়েছে এবং বিয়ে করেছে। অপহৃতার গরিব পিতা আনোয়ারা থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়েটির পিতা চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
২২. ২৬ নভেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় টাঙ্গাইল ধনবাড়ি কলেজের ছাত্রী উপমা সাহা।
২৩. ২৯ নভেম্বর ২০১৫ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর সরিফুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রী হিরামনি অপহরণের শিকার হয়। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও বিবাহের তৎপরতা চালায় অপরণকারী ও তার সহযোগীরা।
২৪. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নোয়াখালী সৈকত ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সুমি রানী মজুমদার। গত ৯ জানুয়ারি ২০১৬ সুমির পরিবার নোয়াখালী প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুমিকে উদ্ধার ও অপহরণকারীদের শাস্তি দাবি করে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা একটি অবধারিত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় প্রতিবছর বাংলাদেশে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালে রাজধানীতে ২২৫টি সহ সারা দেশে মোট ২৮ হাজার ৯৬২টি পূজা মণ্ডপে শারদীয়া দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় এর সংখ্যা বেড়েছে ২৬২টি। ২০১৪ সালে সারাদেশে ২৮ হাজার ৭০০টি, ২০১৩ সালে ২৮ হাজার ২০০টি, ২০১২ সালে ২৭ হাজার ৮শ’টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে প্রতিবছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়লেও ভক্ত বা পূজারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী। আপাতদৃষ্টিতে তাই প্রতিবছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই। আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বীকৃতি দিলেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পারে নি। ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উপর উপর্যুপরি এই হামলার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক যে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা কিংবা তা কার্যকরের সময়েও হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। বিগত ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে নি, বরং তা প্রায় প্রতি বছরই থেকেছে উদ্বেগজনক। প্রতিবছর সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরেরও মহোৎসব শুরু হয়। যা পুরো শারদীয়া দুর্গা উৎসবের যেন এক চিরায়ত কলঙ্কময় অধ্যায়। স্বাধীনতার পর এতোগুলো বছর অতিক্রান্ত হলেও এই কলঙ্ক থেকে এখনো মুক্ত হতে পারে নি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণের বাংলাদেশ। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে উল্লেখযোগ্য হারে ঘটে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। ২০১৫ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসময় দুর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা কালী পূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেকারণে প্রতিমা ভাঙচুর সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও এসময় বেশি ঘটে থাকে। ২০১৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ৩৬টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
পূজার মৌসুম ছাড়াও প্রায় সারা বছরই প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু ডিসেম্বরে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুরের তথ্য উল্লেখ করতে চাই যে মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো পূজার মহোৎসব ছিল না। ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২১টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।
১. ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌরসভার শহরগাছী এলাকায় চন্দনা পাহাড়ী (৩২) নামের এক আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কাজিরবন কালী মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
২. ৫ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার পর্যটন কেন্দ্র দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউর মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে দুর্বৃত্তের ছোড়া হাতবোমা বিস্ফোরণে আহত হন ৯জন।
৩. ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবরশাহ থানাধীন নিউ শহীদ লেন এলাকায় শ্রীশ্রীশ্যামাকালী বাড়ির মন্দিরে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়। এ সময় মন্দিরের আসবাবপত্র ও অন্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়। এতে ৬ জন আহত হয়।
৪. ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ডাবোর ইউনিয়নের জয়নন্দ ডহচি গ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে গুলি ও বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। রাত সোয়া ৮টার দিকে মন্দিরে কীর্তন ও ধর্মসভা চলার সময় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধসহ চারজন আহত হয়।
৫. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রকাশ্যে শিব মন্দিরে হামলা ও ৩টি প্রতিমা ভাঙচুর করে স্থানীয় প্রভাবশালী কলিমুদ্দিন গং। হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানোর কারণে অনেকেই তাদের জমি ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন।
৬. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি গ্রামের উত্তর পাড়া সার্বজনীন মনসা মন্দিরে মনসা মূর্তি ও একই গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের রাধা গোবিন্দ মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
৭. ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের শত বছরের পুরোনো সার্বজনীন কালীমন্দিরের ৭টি প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
৮. ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ রোববার সকালে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় বাউসী বাঙ্গালীপাড়া পদ্মা পূজা মন্দিরের পদ্মা প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
৯. ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ সোমবার রাতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের মহেষপুর গোপপাড়া গ্রামে সার্বজনীন কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে শীতলা মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
১০. ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামের রৌমারীতে উপজেলার নমদাসপাড়া গ্রামে মন্দিরের কালী, লক্ষ্মী ও শিবের মূর্তি ভাঙচুর করে।
১১.২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মির্জাবাড়ি বাজারের কাছে দড়িহাসিল এলাকার মাখন লাল গোপ ও সুবল চন্দ্র গোপের বাড়ির দুটি পারিবারিক কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য একটি উদ্বেগজনক বার্তা। এদেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের পেছনের অন্যতম একটি কারণ এটি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ত্যাগ করে থাকেন। তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে ব্যবসা, বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও মামলার হুমকিসহ হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটে থাকে, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যে কারণে নিরাপত্তাহীন অসহায় পরিবারগুলো বাপ-দাদাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্মভিটা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, রাষ্ট্র এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে কখনও দেখছে না। বরং কখনও কখনও রাষ্ট্রের মন্ত্রী, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় এই হামলার খবর প্রকাশিত হলেও কোনোটির আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি বরং হয়রানির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তাদের যেন এই জায়গাটিতে একটি দৃশ্যমান মিল পরিলক্ষিত হয়। একদিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে এই সব হামলা ও নির্যাতনের বিচার হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। সরকারদলীয় কেউ এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে সেক্ষেত্রে বিচারের প্রত্যাশা আরও ক্ষীণ। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
২৮ অক্টোবর ২০১৫ বুধবার রাতে চাঁদা না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা জেলেপাড়ায় হামলা চালায় আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডাররা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ও পেটের সন্তান। তার পেটে উপর্যুপরি লাথির চোটে ঘটনাস্থলেই মৃত বাচ্চা প্রসব করেন তিনি। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় শিশুটির। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও মারধরে গুরুতর আহত গৃহবধূ তুলসী রানী দাসকে আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- আলোরানী দাস, জহরলাল দাস, শোভারানী দাস, বিকাশ, শুকদেব দাস ও পরিমল দাস। প্রায় ২২-২৫ জনের হামলাকারী দলটি জেলেপাড়ার ঘরবাড়িগুলোতে আচমকা ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করে। প্রতিবন্ধী স্বপন দাসের দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় তারা। এ সময় তাদের ঠেকাতে পাড়ার লোকজন এগিয়ে এলে ক্যাডাররা নিরীহ সংখ্যালঘুদের মারধর শুরু করে। হামলাকারীদের হাত থেকে আহত রবীন্দ্রদাসকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন তার ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তুলসী রানী দাস। এ সময় হামলাকারীরা তুলসীর তলপেট ও কোমরে উপর্যুপরি লাথি মারে। লাঠি দিয়েও তাকে মারধর করে। মুহূর্তেই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি। পরদিন সকালে আহত তুলসীকে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে প্রায় অর্ধশত পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে নৌকায় ছোট ফেনী নদীতে আশ্রয় নেন। পরে রাত সাড়ে ৯টায় পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে জেলে পরিবারগুলো নদী থেকে বাড়ি ফিরে আসে। আর আহতরা রাতে পুলিশের সহযোগিতায় ফেনী সদর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এই ঘটনার কোনো বিচার এখনও হয় নি।
সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিপীড়নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। চাঁদা না পেয়ে ৯ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার মধ্যরাতে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়ার পালপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এতে আহত হয় ৮ জন। ধলিয়া ইউনিয়নের বালুয়া চৌমুহনীর পালপাড়া গ্রামের গোপাল পালের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিল এসকল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। ৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ৭-৮ জন সহযোগী নিয়ে গোপাল পালের বাড়িতে হামলা করে এবং দেশীয় বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দেয়। বাড়ির লোকেরা বাধা দিলে উক্ত ছাত্রলীগ নেতার পিতা স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি তার সহযোগীদের নিয়ে দেশীয় বন্দুক, কিরিচ ও রামদা নিয়ে তাদের ওপর আরেক দফা হামলা করে। বিমল পাল ও গোপালসহ ৮জন আহত হয়। ৯ ডিসেম্বর বুধবার বিকেলে ফেনী মডেল থানায় মামলা করা হলে সন্ত্রাসীরা বুধবার মধ্যরাতে আবারও সশস্ত্র অবস্থায় হাজির হয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দেয়। এ সময় তারা বাড়ির আঙিনায় ৪টি খড়ের গাদায় আগুন দেয়। এরপর আতঙ্কে পালাপাড়ার কয়েকটি বাড়ির লোকজন পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের দায়ের করা অভিযোগ মামলা আকারে গ্রহণ করতে থানা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন না এমন অভিযোগও বিস্তর রয়েছে। গত ডিসেম্বরে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে পটুয়াখালীতে। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপেজলার আলীপুর গ্রামের ২টি সংখ্যালঘু পরিবারের ১২জন সদস্যকে হত্যার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এক প্রভাবশালী। সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে উক্ত ২ পরিবারের মধ্যে ১টি পরিবারের প্রধানকে গত ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ অপহরণ করে তারা। পরিবারের সদস্যরা অপহরণ মামলা করতে গেলে কলাপাড়া থানার পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা নেয় নি। এরপর ভুক্তভোগী পরিবার উক্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে মামলা করলে আদালত অভিযুক্তদের তলব করেন। এর পর থেকেই প্রভাবশালী মহল উক্ত পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। এভাবে প্রভাবশালীরা সারাদেশে হিন্দুদের ভিটেমাটি দখল করে তাদের নিঃস্ব করছে। বাধ্য হয়ে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করছে। এসকল প্রভাবশালীদের মদদ দিচ্ছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই ঘটনায় ওসি অপহরণের মামলা না নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে যে এসকল ভূমি-দস্যুকে প্রশাসন কোন না কোনভাবে সহায়তা করছে। বেশিরভাগ ভূমি-দস্যুই ক্ষমতাসীন দলের। তারা হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। এদের ক্ষমতা এবং দাপটের কাছে অসহায় হয়ে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয় হিন্দু পরিবারগুলো। যারা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, তারা নিজেরাই উল্টো অত্যাচারীদের মদদ দেয়। প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকায় এ ধরনের খবর পাওয়া যায়। ভূমি-দস্যু এবং দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার খবর সেই তুলনায় নেই বললেই চলে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে দখলবাজি আরও বেড়ে যায়। যদি একের পর এক হিন্দুদের ভিটেমাটি দখল করে ঘরছাড়া করা হয় তাহলে এক সময় দেশে হিন্দু সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতার আরও ১টি অভিযোগ উঠেছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ৫৫ হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের তৎপরতা বন্ধের দাবিতে গত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতার ভূমিদস্যুরা ৫৫টি সংখ্যালঘু পরিবারের সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ওপর নানা উপায়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের চন্ডিপুর ইউনিয়নে ৭ পুরুষ ধরে পরিবারগুলো বাস করে আসছে। তাদের জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২৫ একর। এ জমিতে বসতভিটা ছাড়াও রয়েছে আবাদি জমি ও মন্দির। ভূমিদস্যুরা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ও সন্ত্রাসী দিয়ে হয়রানি, মারধরের মাধ্যমে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করার চেষ্টা করছে। সংখ্যালঘু হওয়ার সুযোগে তাদের পুড়িয়ে হত্যা, স্ত্রী-মেয়েদের ধর্ষণ ও দেশ থেকে তাড়ানোর হুমকি দিচ্ছে। তাদের ভয়ে সংখ্যালঘুরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসন তাদের কোনো সহায়তা করছে না। যদি কোনো সমাধান না হয় তাহলে তাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানান তারা।
এ জাতীয় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই যেটি ঘটেছে নওগাঁর মহাদেবপুরে। সেখানে উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের চাহিদামত ঘুষ দিতে না পারায় এক সংখ্যালঘুর ৩২ বছর ধরে দখলে থাকা সম্পত্তি অন্যের নামে লিজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভিপি সম্পত্তি লিজের ক্ষেত্রে লিজ গ্রহীতার অগ্রাধিকারের বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে সে বিধান মানা হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়। এদিকে নতুন লিজ গ্রহীতা জমি দখল নিয়ে উক্ত সংখ্যালঘু পরিবারটিকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে এবং প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছে। এছাড়াপ্রায় ৫শত হিন্দু পরিবারের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জের মাহমুদপুরের মাতবর এ্যাগ্রো ফিশারিজের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জে হিন্দু অধ্যুষিত মাহমুদপুর বিলে জোর করে মৎস্য প্রজেক্ট করার মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছে উক্ত মাতবর এ্যাগ্রো ফিশারিজ। এখানে এ প্রকল্প হলে গ্রামের অন্তত ৫ শ’ হিন্দু কৃষি পরিবার তাদের পেশা হারাবেন। গ্রামের হিন্দুদের জমি ফিশারিজের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
২০১৫ সালে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ২৪ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৩৯জন। গুরুতর হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ফরিদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অলোক সেন। ২৪ নভেম্বর ২০১৫ তাকে ফরিদপুর শহরের নিজ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত করে কতিপয় মুখোশধারী সন্ত্রাসী। অলোক সেন ফরিদপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। এছাড়া ৫ অক্টোবর ২০১৫ সকালে বাসায় ঢুকে পাবনার ঈশ্বরদীর ফেইথ বাইবেল চার্চের যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তিন যুবক। বেশ কয়েকজন যাজককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। রংপুরের ১জন খ্রিস্টান ফাদার ও বিভিন্ন চার্চে কর্মরত আরও ৯জন পাদ্রিকে ডাকযোগে পাঠানো চিঠির মারফত হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ আঞ্চলিক ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ রংপুরের পালক প্রধানের নামে হত্যার হুমকি সংবলিত চিঠি আসে গত ২৫ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে। এ ছাড়াও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ক্যাথলিক মিশনের ফাদারকে হত্যার হুমকি দেয় দুর্বৃত্তরা। খুলনাতেও খ্রিস্টান ধর্মীয় যাজকদের উপর হত্যার হুমকি আসে এ মাসে। ২৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুরে মোবাইল ফোন মারফৎ বাংলাদেশ ইন্টারচার্চ পাস্টরস এন্ড লিডারস ফেলোশিপের খুলনা বিভাগের নির্বাহী সচিব এবং চার্চ অব গড এর বাংলাদেশ প্রধানসহ খুলনা বিভাগ ক্যাথলিক চার্চের বিশপকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ বছর মোট ৫২টি হত্যার হুমকির খবর জানা গেছে। শুধু ডিসেম্বরে বড়দিন উদাযাপনের পূর্বে দুইজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকসহ সারাদেশে ৩৭জন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীকে হত্যার হুমকি আসে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের নেতৃত্বে সকল হিন্দু সংগঠন নিষিদ্ধের দাবি এবং তার প্রেক্ষিতে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের কঠোর প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি এদেশের হিন্দুদের মধ্যে সংশয়ের জন্ম দেয়। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ ও সমমনা ১৩টি সংগঠন বাংলাদেশের সকল হিন্দু সংগঠন নিষিদ্ধের দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। এসব দাবির মধ্যে ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নিষিদ্ধ ঘোষণা, জাগো হিন্দু পরিষদ, ইসকন, হিন্দু মহাজোট, বেদান্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সনাতন মৈত্রী সংঘ, আর্য সমাজের কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণার দাবি প্রভৃতি।
আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ সুবিধা পাবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, গোষ্ঠী, বা সম্প্রদায় যা-ই হোক না কেন, আইন যেমন সবার জন্য সমান হবে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, উৎসব করার স্বাধীনতা সবার বেলায় সমান হবে। এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না এটাই প্রতিটি নাগরিকের কাম্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আশানুরূপ নয়। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সামাজিক অনুশাসনে বহুত্ববাদের (Pluralism) স্বীকৃতি ও চর্চার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এদেশের সংখ্যালঘুরা নিজদেশেই ঐতিহাসিক কাল ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবহেলা ও বঞ্চনা শিকার হচ্ছেন। তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। প্রতিনিয়ত তাদেরকে নিজেদের আবাস থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। এথনিক ক্লিনজিং-এর যে চর্চা দূর অতীত থেকে এই ভূখণ্ডে চলে এসেছে আজও তা অব্যাহত রয়েছে। এদেশে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী কালক্রমে আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃক ধর্মকে ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকীকরণের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছেন, বেড়েছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর ধারনা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাকে অকার্যকর করেছে, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, প্রকৃতি পূজারী নির্বিশেষে সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা ও সম্পত্তি দখল, মন্দির, প্রতিমা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গ্রন্থ প্রভৃতি ধ্বংস করে এ প্রক্রিয়াকে সহায়তা যোগাচ্ছে। আমরা চাই এক্ষেত্রে রাষ্ট্র হবে আরও মানবিক। সকল সম্প্রদায়ের ও ধর্মীয় মতাদর্শের জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে আজকের বাংলাদেশ।
রিপোর্ট প্রণয়নে
প্রিয়া সাহা
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ

Sunday 31 January 2016

রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় চরিত্র এবং বাংলাদেশ

রাষ্ট্র ব্যাবস্থার উদ্ভব নিয়ে চিন্তা করলেই, রাষ্ট্রের নির্মম, নির্দয়, নগ্ন চরিত্রের প্রমান পাওয়া যায় রাষ্ট্রের উৎপত্তির শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই দানবীয় এবং নারকীয় চরিত্র বিদ্যমানচিরকাল ধনিক শ্রেনীকে রক্ষা করে রাষ্ট্র শোষনের হাতিয়ারে পরিনত হয়েছেকালের বিবর্তনে গোত্র থেকে রাষ্ট্র ব্যাবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছে পৃথিবীময় ইচ্ছে করলেই কোন রাষ্ট্র কিংবা সমাজ এখন আর গোত্র ব্যাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনা পুঁজিবাদ এমনি জেঁকে বসেছে, ব্যাক্তির চিন্তা-চেতনা, সমাজ-সংসার কিছুই এটি থেকে মুক্ত নয় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সর্বময়, ব্যাক্তির জীবন, ধর্মীয় বিশ্বাস, মানবের সম্পর্ক এমনকি চিন্তার স্বাধীনতায়
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি একটি স্বৈরাচার, ডাকাত এবং নির্যাতনকারীদের রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে এই বদ্বীপের মানুষগুলো আরেকটি রাষ্ট্রের যাতাকলে পতিত হয় তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ নামে আরেকটি শাসন-শোষনের খাচায় আবদ্ধ হয়মানুষগুলোর ভাগ্যের হাত বদল হয়, কিন্তু মুক্তি আর মেলেনা মুক্তি যেন সুদুর পরাহত, স্বপ্নে আর কল্পনায় বাস করে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই নিজ ভূমির ধনিক শ্রেণী কর্তৃক আবার দানবীয় শাসনের খড়গ নেমে আসে দুর্যোগের মত।  শেখ মজিবের নেতৃত্বে ছিনতাই হওয়া রাষ্ট্রের কর্তিত্ব ধনিক শ্রেনীর হাতে পড়েসেই থেকে শুরু আজ অবদি চলছে৭৪' দুর্ভিক্ষে এত মানুষ মারা গেল, রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই, দায় নেই শাসক শ্রেনীরযখনি কিছু মানুষ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির হর্তাকর্তা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে, তখনি রাষ্ট্রযন্ত্র বলপ্রয়োগে তাদের হত্যা করেছেবিপ্লবী সিরাজ সিকদার সহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে তত্কালীন শাসকবর্গরক্ষীবাহিনীর মত কুখ্যাত বাহিনী লেলিয়ে দিয়েও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি গণ মানুষের প্রতিরোধের মুখে
মানুষকে শোষনের বেড়াজালে আবদ্ধ করার নিকৃষ্ট পদ্ধতিটি হচ্ছে ''ব্যাবসা''। ব্যাবসা মানেই পুঁজির সমাবেশআর পুঁজির সমাবেশ মানেই রাষ্ট্রের নির্লজ্জ উপস্থিতি। রাষ্ট্র ব্যাবসা করে নাগরিকের সাথেরাষ্ট্র ব্যাবসা করে মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলো নিয়েরাষ্ট্র ব্যাবসা করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বেসরকারীকরণের নামে রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এলিট শ্রেনীর কাছে তুলে দেয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী ব্যাবসা করেপুলিশ ব্যাবসা করেসরকার ব্যাবসা করে কেবল সাধারণ মানুষ ঠকে। রাষ্ট্র রেকর্ডের পিছনে ছুটেলাখ কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গায়। রাষ্ট্রযন্ত্র ভাত দিতে পারেনাকিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। গণমানুষের শ্রমেঘামে আররক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠা রাষ্ট্রটি আজ দস্যু কবলিতবাংলাদেশরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক চারণভূমিতে পরিনত হয়েছে। শাসক শ্রেণী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে নাগরিকদের বিরুদ্ধে।  রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু তারপরও এই ভুয়া শাসক শ্রেনীকে অবৈধ বলা যাবেনা। কারণ প্রতিবাদ করলেই তারা সন্ত্রাসী কিংবা রাষ্ট্র বিরোধী অভিহিত করে
চিকিত্সা নিয়ে নির্লজ্জ ব্যাবসা, এই রাষ্ট্রটির অন্যতম চরিত্রএখানে মানুষের চেয়ে জড় বস্তুর মুল্য বেশি।   রাষ্ট্রের শাসকরা হাঁচি-কাশি, সর্দি হলেই সিঙ্গাপুরে উড়াল দেয় উন্নত চিকিত্সার জন্য, বাকি মানুষগুলো ধুকেধুকে মরছে নিরবে, নিভৃতে অবহেলায়শাসকযন্ত্রের ছত্রছায়ায় এইখানে চিকিত্সা নিয়ে ব্যাবসা হয়রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বদা তথাকথিত ''কল্যাণকামী রাষ্ট্র '' ''গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র'' কিংবা সস্তা ''জাতীয়তাবাদের'' কথা বলে মানুষকে দাবিয়ে রাখেরাষ্ট্র কি আদৌ কল্যাণকামী কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারে ? তথাকথিত উন্নত দেশ(আমেরিকা, যুক্তরাজ্য , জাপান , ফ্রান্স) কিংবা পুঁজিবাদী দেশগুলোকে কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা হয়মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই কি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের একমাত্র বৈশিষ্ট ? ধনী দেশগুলো আর গরিব দেশ গুলোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, ধনী দেশগুলো নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে আর গরিব দেশগুলো করেনালক্ষনীয় ব্যাপার হলো, ধনী দেশ হোক আর গরিব দেশ হোক কোথাও গণমানুষের অংশগ্রহন নেইআছে শুধু পুঁজিবাদের অবাধ স্বাধীনতা আর শোষিত হওয়ার উপলক্ষরাষ্ট্রযন্ত্রের এই শাসন -শোষণ মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে

বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি চরম হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে, যেখানে কৃষক শ্রেণী দুবেলা ভাত খেতে  পারেনা, সেখানে ''জাতির জনক '' নামে এক ব্যাক্তির গুনগান গাওয়া হয়, গুনগান গাইতে বাধ্য করা হয়রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের এক মহা উত্সবে সামিল হয়েছে শাসকবর্গপুঁজির সমাবেশ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় তারা লুটে নিচ্ছে মানুষের সম্পদ।  সম্পদ সংগ্রহের এমন স্বাধীনতা ধনিক শ্রেনীকে আরো বেশি নীপিডক হতে সাহায্য করেছেব্যাঙ্কিং থেকে বিচারালয়, প্রশাসন থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় এই নীপিডকদের সরব উপস্থিতিবিচারালয়, প্রশাসন এই নীপিডক শ্রেনীকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে
রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম কূটকৌশল হলো জাতীয়তাবাদের ধুয়া তোলা এবং বার বার প্রচার করা জাতীয়তাবাদের মূলা ঝুলিয়ে মানুষকে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ থেকে দুরে রাখা বাংলাদেশের ডাকাত সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি বলে সমাজকে বিভক্ত করে শোষণ করে যাচ্ছে আর প্রতিরোধ, প্রতিবাদের চেষ্টা করলেই নিপীডন করে স্তব্ধ করে দিচ্ছেরাষ্ট্রযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী নিপিডকের ভূমিকায় নেমেছে কোথাও কোনো প্রতিরোধ নেই, আন্দোলন নেই , নেই কোনো সংগ্রাম দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিরোধ করার মত কোনো শক্তি বাংলাদেশে আর অবশিষ্ট নেই তরুণ প্রজন্ম মদ, নারী আর ইন্টারনেট নিয়ে ব্যাস্ত ভোগ করাই যেন মানব জীবনের সার্থকতা রাষ্ট্র, সমাজ তরুণ প্রজন্মকে ভোগবাদী করে গড়ে তুলছে

এভাবে আর কতকাল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিরোধ এসেছে কৃষক শ্রেণী থেকে, গণমানুষ থেকে রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনো বৃথা যায়না, হয়তো সাময়িক দাবিয়ে রাখা যায় কিন্তু বিজয় নিশ্চিত অবৈধ রাষ্ট্রযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে যদি সামরিক বাহিনী চেষ্টা করা, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবেরাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি উপাদানকে আঘাত করতে হবে, আঘাতে আঘাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দিতে হবে গণমানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান এই রাষ্ট্রকে মুক্ত করে মানুষের রাষ্ট্রে  তথা গণরাষ্ট্রে পরিনত করতে হবে

লেখক : আজিমুল হক খান 
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মানবাধিকার কর্মী