Sunday, 1 January 2017

শেখ মুজিব থেকে হিটলার

একটা পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মহান হৃদয় সম্পর্কিত একটা লেখা পড়ার দুর্ভাগ্য হলো। লেখাটি পড়ে জানতে পারলাম, মুক্তিযুদ্ধের পরে দালাল আইনে মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং শাহ আজিজ আটক হয়। এ সময়ে সবুর খান বঙ্গবন্ধুর কাছে একটা চিঠি লেখে, চিঠিতে পুরনো সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সবুর খান জেল থেকে মুক্তি কামনা করে। মহান হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিঠিটি পড়ার সাথে সাথে সবুর খানকে মুক্তি দেয়ার হুকুম দেন, এবং অন্যান্যদেরকেও মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। সবুর খান এবং শাহ আজিজ মুক্তি পান সেসময়ে। ব্যাপারগুলো আগেও জানতাম, এমন নয় যে এবারই প্রথম জানতে পারলাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী। তিনি আইনের উর্ধ্বের কোন মানুষ ছিলেন না। সবুর খান, শাহ আজিজের মত নেতারা আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলে সহজেই মুক্তি পেতে পারতেন। দোষী হলে সাজাও পেতেন। কিন্তু জনগণের দেয়া ক্ষমতার ব্যবহার করে এদের মুক্তি দেয়া কতটা মহান হৃদয়ের কাজ ছিল, আর কতটা বিচার ব্যবস্থাকে ডিঙ্গিয়ে একনায়কসূলভ কাজ ছিল তা নিয়ে আমি সন্দিহান। বরঞ্চ আমি হলে সবুর খানকে ফিরতি একটা চিঠি লিখে জানাতাম,

" প্রিয় সবুর খান। আপনার প্রতি কোন বিদ্বেষ কিংবা ঘৃণা আমার নেই। সেই সাথে, প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামোতে আমি একজন প্রধানমন্ত্রী মাত্রই। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আমি নই। প্রচলিত আইনের প্রতি আমি দায়বদ্ধ বিধায়, গ্রেফতারকৃত কাউকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ আমি করতে পারি না। কারণ আমাকেও আইন মেনে চলতে হয়। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রাখুন, নিশ্চয়ই আপনি নির্দোষ হলে মুক্তি পাবেন। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক যত মধুরই হোক না কেন, আমি আইনের বাইরে এক পাও এগুতে পারবো না। কারণ আমি জনগণের দেয়া ম্যান্ডেটের কাছে দায়বদ্ধ। "

আমি জানি যে, সিরাজ শিকদারকে বঙ্গবন্ধু শাসনামলে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যেটা ছিল আধুনিক সময়ের ক্রসফায়ারের সূচনা। সিরাজ শিকদার যাই করুক না কেন, তার ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল। আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। হত্যার পরে সদম্ভে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টে লাল ঘোড়া দাবরাইয়া দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। বিনা বিচারে সিরাজ শিকদারের মত মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করা হলেও, মুসলিম লীগ নেতাদের পুরনো খাতিরের সম্পর্কের কারণে মুক্তি দেয়া অনেকের কাছে মহান হৃদয়, বড় মন, বিশাল নেতার খেতাব পেলেও আমার কাছে সেগুলো সবই বিচার বহির্ভূত ক্ষমতার অপব্যবহার। সেই শুরুতেই যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেত, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের পিতা না হয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, একজন সাধারণ সেবক হতেন, আইন এবং সংবিধান মেনে চলতেন, আত্মীয়তা কিংবা স্বজন হওয়ার কারণে কোন ক্ষমতার ব্যবহার না করতেন, আমার কাছে বঙ্গবন্ধু বড় নেতা হতেন। কিন্তু এইসব গল্প আমার কাছে বড় নেতার পরিচয় বহন করে না। একজন স্বেচ্ছাচারী একনায়কের পরিচয় বহন করে। যা রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কয়েকশো বছর পিছিয়ে দিয়েছে।

আসুন, এবারে নতুন আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া লোকজন এসে আমার বাপমা তুলে গালাগালি করে অশেষ পুণ্য অর্জন করুন।

আওয়ামী লীগ দেশকে নিয়ে যাচ্ছে মধ্যযুগে!

আওয়ামী লীগ দেশকে নিয়ে যাচ্ছে মধ্যযুগে!

প্রাচীনকালে রাজাবাদশাদের, তাদের সন্তানাদির সমালোচনা করা ছিল নিষিদ্ধ। রাজার সমালোচনা করলেই গর্দান যেত। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমলেও সরকারের সমালোচনা করে বহু বিপ্লবী নির্যাতন নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন। স্বাধীন বাঙলাদেশে আমাদের দেশের সংবিধান আমার বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমি যে কোন মত প্রকাশ করতে পারি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার মতামত দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দিবে।
আধুনিক যত বাক স্বাধীনতা এবং মুক্তমত প্রকাশের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে পরিষ্কারভাবেই বলা হচ্ছে যে, যেকোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, দল, মতাদর্শ, বিশ্বাস ইত্যাদি যে কেউ চাইলেই গ্রহণ বা বর্জন করতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে, কটাক্ষ বা অবমাননা করতে পারবে। সে কিছু নিয়ে কার্টুন আঁকলে তার আতঙ্কে থাকতে হবে না যে, কেউ তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে যাবে। কিংবা রাষ্ট্র এসে তাকে জেলে ঢুকাবে। এগুলো সভ্য সমাজের নিয়ম, বাঙলাদেশ যার থেকে শত বছর পিছিয়ে আছে। সেই সাথে, বাক স্বাধীনতার মানে এটা যে, আপনি কাউকে হত্যার হুমকি দিতে পারবেন না, ধর্ষণ বা হত্যার সম্পক্ষে বক্তব্য রাখতে পারবেন না, গণহত্যা কিংবা ধর্ষনের পক্ষে মতামত দিতে পারবেন না। এগুলো বাক স্বাধীনতার লঙ্ঘন।

আমি রাজনৈতিক দলসমুহ এবং তাদের নেতাদের সমালোচনার অধিকার রাখি, সরকারের, পুলিশের, ধর্মীয় সংগঠনের এমনকি বিচার বিভাগেরও যেকোন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে পারি। আমার এই অধিকার কারো দয়া দাক্ষিন্য নয়, করুণার দান নয়। এমন নয় যে এই নির্বাচিত সরকারটি আমাকে করুনাবশত একটু আধটু সমালোচনা করতে দিচ্ছে। এটা আমার নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার, সংবিধান আমার এই অধিকারের রক্ষক।
এমনকি, এই সংবিধান আমাকে এই সংবিধানের সমালোচনা করার অধিকারও সংরক্ষন করে। আমি বলতে পারি সংবিধানের বিসমিল্লা একটি প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ, যা আমাদের দেশের অমুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকের ধারণা তৈরির সহায়ক। আমি বিচার বিভাগের কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দ্বিমত পোষন করতে পারি, আমি নির্বাচিত এই সরকারের সর্বোচ্চ পদের মানুষটিরও সমালোচনার অধিকার রাখি। কারণ আমি(আমরা) একজন নাগরিক, এবং আমিই(আমরা) এই রাষ্ট্রের মালিক। আওয়ামী লীগ এই রাষ্ট্রের মালিক নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এই রাষ্ট্রের মালিক নয়।

এমনকি আমরা এই দেশের জাতীয় নেতা, তাদের শাসনামলের সমালোচনাও করতে পারি। এই সমালোচনা ঠিক হতে পারে, বা ভুল-সেটা যুক্তিতর্ক, তথ্যপ্রমাণের উপরে নির্ভরশীল। কে তার সপক্ষে কতটুকু যুক্তি তুলে ধরতে পারছে, সেটাই হবে সমালোচনার শুদ্ধতার মাপকাঠি। কিন্তু সমালোচনা করা যাবে না, বা সমালোচনা করলেই হৈ হৈ রৈ রৈ করে কল্লা ফেলে দেবার জন্য দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দেয়া কিংবা নত্যনতুন অসভ্য আইন করে মতামত দমন করা কোনভাবেই সভ্য সংস্কৃতি হতে পারে না। এটা পুরোপুরি মোল্লাতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। পাকিস্তানি ভুত আমাদের মাথায় ছিল, এখন সেটা রাষ্ট্রের মাথায় চড়ে বসেছে। বাঙলাদেশ এখন মুজিবানুভূতি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। যেটা সৌদি আরব, ইরান আর উত্তর কোরিয়াতে চালু আছে, বাঙলাদেশ সেই পথে এখন এগিয়ে যাচ্ছে বেশ খানিকটা। তারা আইন করতে যাচ্ছে, যেকোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে (বৈদ্যুতিক) মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা চালালে বা অবমাননা করলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।

শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফ বলেছেন, 'মুজিবুর রহমান স্বয়ং ছিলেন স্বল্পজ্ঞান। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অবধি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আলোচনা চালিয়ে গেছেন। তিনি স্বাধীনতা চাননি। বাঙ্গালীর স্বভাব হচ্ছে হুজুগে। তাই তারা কাক শিয়ালের মতো না বুঝে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মেনে নিল।'
(উল্লেখ্য, শেখ মুজিব সেই সময়ে তাজউদ্দীনকে ভারতের সাথে আলোচনা করতে পাঠান, এবং খন্দকার মোশতাককে পাঠান পাক বাহিনীকে বোঝাতে! )

ড. আহমেদ শরীফের অগ্রন্থিত ডায়েরী থেকে আরও-

" মুজিববাদী আঁতেলরা এমন বেহায়া চাটুকার যে কোন মিথ্যাভাষণে তাদের কোন লজ্জা-শরম নেই। তাঁরা জানেন মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার কোনো স্বপ্ন বা সাধ ছিলো না, তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর চেলা এবং মুসলিম লীগার ও হিন্দুবিদ্বেষী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিলো তাঁকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। কেননা আগরতলা মামলা তাঁকে অপমানিত, ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ বাঙালীর হিরো বানিয়ে দিয়েছি। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ অবধি প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য দককষাকষি করেছিলেন, যদিও যে লক্ষ্যে ছাত্রনেতাদের পরামর্শে তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ও মুক্তির সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রাপ্তি ত্বরাণ্বিত করার লক্ষ্যেই। প্রমাণ তিনি ঐ সভার পরেই দ্রোহী হন নি, ছাত্ররাও ধরে নি অস্ত্র।

তিনি স্বাধীনতা চান নি। তরুণেরা তারুণ্যের আবেগ বশবর্তী হয়ে স্বাধীনতার দাবি ও সঙ্কল্প তাঁকে দিয়ে জোর করে তাঁর মুখে উচ্চারণ করিয়েছিলো তাঁর আপত্তি ও পরিব্যক্ত অনীহা সত্ত্বেও। তাঁর বাড়ীতেও ওরাই স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলো তাঁর হাতেই। মানুষের বিশেষ করে বাঙালীর স্বভাব হচ্ছে হুজুগে তাই তারা কাক-শিয়ালের মতো বুঝে না বুঝে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মেনে নিলো। সেভাবেই তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য নিবেদন করলো।"

এখন শ্রদ্ধেয় আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে কী মামলা দেয়া হবে?