Sunday, 28 July 2024
ইনিয়ে-বিনিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জামায়াত-শিবির-রাজাকার হিসেবে ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা
একটি ব্যক্তিগত ঘোষণা
---------------------------------
নিজের সম্বন্ধে কিছু বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু এই পোস্টটি বিশেষ কারণে 'আমি'ময়। কারণ জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে সঙ্গ, সংঘ, বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, যদিও ভেবেছিলাম এসব বিষয়ে মীমাংসা হয়ে গেছে, নতুন করে আর ভাবতে হবে না।
যারা আমাকে বাস্তবে চেনেন, কিংবা বাস্তবে না হলেও ফেসবুকে চেনেন বা ফলো করেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন আমি অন্যের মতপ্রকাশ এবং মতাদর্শ ধারণের ব্যাপারে কতটা সহিষ্ণু এবং সহনশীল। আমার চিন্তার সঙ্গে একেবারেই মিল নেই, এরকম মানুষও অবলীলায় আমার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে পারে, সে প্রমাণ আপনারা নিশ্চয়ই পেয়েছেন। আমি এমন এক পরিবারে, এমন এক পরিবেশে, এমন এক সময়ে বেড়ে উঠেছি যেখানে পরমতসহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা এক নিয়মিত চর্চার বিষয় ছিল। এখনো আমি সেই পথ ছাড়িনি। আমি বিশ্বাস করি -- অপরের মতাদর্শের ব্যাপারে উদারতা, অপরকে গ্রহণ করার মানসিকতা এবং অপরের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সহিষ্ণু না হলে মানুষ হিসেবে বড়ো হওয়া যায় না। সেজন্যই ফেসবুকে আমার বন্ধু-তালিকায় সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের মানুষ রয়েছেন। তাদের সঙ্গে নানা সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে আমার বিতর্ক হয়েছে, তবে পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় রেখে; সেজন্য সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু জীবনের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছি যে সেই সিদ্ধান্তও পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।
লক্ষ করেছি, কোটাসংস্কার আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকেই কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জামায়াত-শিবির-রাজাকার হিসেবে ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর সেই সংবাদ সম্মেলনের পর শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদকে এবং ভুল করে দেওয়া একটা শ্লোগানকে (যে ভুল তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে সংশোধন করে নিয়েছে ) ভয়ংকরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু হলো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রায় সবাই এবং ছাত্রলীগের একটা বড় অংশ যুক্ত ছিল এবং আছে। অথচ এদের সবাইকে গণহারে রাজাকার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সরকারপন্থি মিডিয়া, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং সরকারি ফেসবুকাররা। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিলেন, শিক্ষার্থীদের ঔদ্ধ্যতের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা লক্ষ করলাম, সরকার হঠাৎ করেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য ছাত্রলীগের সঙ্গে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৬ জুলাই সারাদেশে ছ'জন নিহত হলেন, তখনও আমি সরকারকে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে লিখলাম। সরকারের কানে সে আহ্বান পৌছলো না। ১৮ তারিখের শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে পুলিশ, বিজিবি এবং ছাত্রলীগ সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালালো। নিহত হলো ৪১ জন! সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং আমরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে রইলাম। ১৯ জুলাই শুক্রবার কোনো টেলিভিশন কোনো চ্যানেলেই সারাদিনেও কিছু জানা গেল না। শনিবার সকালে পত্রিকার পাতা খুলে দেখলাম, শুক্রবার ৭৫ জন নিহত হয়েছেন! পত্রিকার হিসাব মতে আজ (২৮ জুলাই) পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০৯। প্রকৃত সংখ্যা কত কেউ জানে না। এসব বিষয়ে বিস্তারিত লিখবো। আজকের বিষয় ভিন্ন।
বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, নিহত শিক্ষার্থীদের চরিত্রহননের জন্য যথারীতি তাদেরকে শিবির ট্যাগ দিচ্ছেন আমারই ফ্রেন্ডলিস্টের কিছু 'মানুষ' (?), অর্থাৎ তারা এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং এইসব খুনকে জাস্টিফাই করছেন। এখনো তারা নিষ্ঠার সঙ্গে তা করে যাচ্ছেন।
আগেই বলেছি, অপরের মতপ্রকাশের ব্যাপারে আমি সহনশীল। কিন্তু খুনকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের ব্যাপারে কীভাবে সহনশীল হওয়া যায়? আমার একদম তরুণ বয়সে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং ঘোষণা করেছিলাম, জামায়াত-শিবির-রাজাকারদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখবো না, রাখিওনি। আজও আমার সেই অবস্থান অক্ষুন্ন আছে। তাই বলে আপনাদের মতের সঙ্গে না মিললে যখন যাকে ট্যাগ দিতে ইচ্ছা করবে তাকেই রাজাকার বলবেন, তা তো হতে পারে না। কেবল তাই নয়, এই বিপুল হত্যাকাণ্ডকে আপনারা সমর্থন করছেন আপনাদের ইচ্ছেমতো বয়ান দিয়ে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আজকে আমাকে যদি খুন করে সরকার, আপনি তো এই একই কাজ করবেন। তাহলে আপনার সঙ্গে কিসের বন্ধুত্ব আমার?
অতএব, আমি সজ্ঞানে এবং সচেতনভাবে ঘোষণা করছি, যারা কোনো-না-কোনোভাবে এইসব রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড এবং নিপীড়নের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তাদের সঙ্গে আমি ফেসবুকে বা বাস্তব জীবনে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নই। আজকের পর যদি হঠাৎ দেখেন, আপনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলেন কিন্তু এখন নেই, বুঝে নেবেন -- আমি আপনাকে 'খুনীর সমর্থক খুনী' হিসেবে চিহ্নিত করেছি এবং আপনার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছি। তাতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না, আমারও হবে না। সত্যি বলতে কি, আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার কথাই ছিল না। আপনি মানুষ হত্যাকে সমর্থন করেন আর আমি মানুষ তো দূরের কথা, বিনা কারণে একটা পিঁপড়া মারাকেও অন্যায় মনে করি। পার্থক্যটা বুঝতেই পারছেন! হয়তো কিছু মতাদর্শিক মিল ছিল বলে বন্ধু ভেবেছি এবং ভুল করেছি। এবার সেই ভুল সংশোধনের পালা।
জীবনটা খুব দীর্ঘ নয় এবং জীবনের অধিকাংশ সময় পেরিয়ে প্রায় শেষ বেলায় পৌঁছে গেছি আমি। অন্তত এইটুকু স্বস্তি নিয়ে থাকতে চাই, যে, খুনীদের সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখিনি, তা সে যে দলেরই হোক।
Subscribe to:
Posts (Atom)