রক্ষীবাহিনীর হাতে আটক থাকাকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অরুণা সেন-এর বিবৃতি
১৯৭৪ এর ১৭ মার্চ এই বিবৃতি প্রথম সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের জুনে তা ‘সংস্কৃতি’ নামে আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অরুণা সেন ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী। শান্তি সেন সাম্যবাদী দলের নেতা ছিলেন।
তার পুত্রের নাম ছিল চঞ্চল সেন। বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ভেদেরগঞ্জের রামভদ্রপুরে শান্তি সেনের জন্ম। রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যই অরুণা সেন রক্ষীবাহিনীর নিগ্রহের শিকার হন। তার নিমোক্ত বিবৃতি থেকে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের পদ্ধতিগত দিক সম্পর্কে বিশেষ ধারণা পাওয়া যায়। ২০০৫ সালের ৫ জুন মিসেস অরুণা সেন মারা যান।
অরুণা সেন-এর বিবৃতি
গত ১৭ আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লােকেরা আমাদের গ্রামের উপর হামলা করে। ঐদিন ছিল হিন্দুদের দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। খুব ভােরেই আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে মারপিট করে তারা। লক্ষণ নামে কলেজের এক ছাত্র এবং আমাকে তারা নড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী শান্তি সেন এবং পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের ধরিয়ে দিন। আরাে জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। লক্ষণকে সেদিন রেখে পরদিন ছেড়ে দেয়। সে যখন বাড়ি ফিরে, দেখি মারধােরের ফলে সে গুরুতর অসুস্থ। চার পাঁচদিন পর আবার তারা রাত্রিতে গ্রামের উপর হামলা করে। অনেক বাড়ি তল্লাশি করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামে দুই যুবককে মারতে মারতে নিয়ে যায়। আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। তাদের আত্মীয়রা ক্যাম্পে গেলে বলে দিয়েছে। সেখানে নেই। তাদের মেরে ফেলেছে বলেই মনে হয়। এরপর থেকে রক্ষীবাহিনী মাঝে মাঝেই গ্রামে এসে যুবকদের খোঁজ করত। কিন্তু তেমন কোনাে ব্যাপক হামলা হয়নি।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত্রি থাকতে এসে রক্ষীবাহিনীর বিরাট একটি দল আমাদের সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ঘিরে ফেলল। ভােরে আমাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম গ্রামের প্রায় অধিকাংশ সক্ষমদেহী পুরুষ উপস্থিত- এমনকি বালকদের পর্যন্ত এনে হাজির করেছে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হােসেন খাঁ তদারক করছে সব। আমার সামনে রক্ষীবাহিনী উপস্থিত সকলকে বেদম মারপিট করে। শুনলাম এদের সকলকে ধরতে গিয়ে বাড়ির মেয়েদেরও প্রচণ্ড মারপিট করেছে এবং অশ্লীল আচরণ করছে। তাদের একদফা মারপিট করে রক্ষীরা আমাকে বললাে পানিতে নেমে দাঁড়াতে। সেখানে নাকি আমাকে গুলি করা হবে। আমি নিজেই পানির দিকে নেমে গেলাম। কিন্তু নদীর পানি দূরে সরে যাওয়ায়, হাঁটু সমান কাদাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওরা তাক করে রাইফেল ধরল গুলি করবে বলে। কিন্তু পরস্পর কি যেন বলাবলি করে রাইফেল নামিয়ে নিল। কাদার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। কমান্ডার গ্রেফতার করা লােকদের হিন্দু-মুসলিম দুই ভাগ করে দুই কাতারে দাঁড় করালাে। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বললাে, “মালাউনরা আমাদের দুশমন। তাদের ক্ষমা করা হবে না। তােমরা মুসলমানরা মালাউনদের সাথে থেকো না। তােমাদের এবারকার মতাে মাফ করে দেওয়া হল।” এই বলে কলিমদ্দি ও মােস্তফা নামে দু’জন মুসলমান যুবককে রেখে আর সবাইকে এক এক বেতের বাড়ি দিয়ে বললাে, “ছুটে পালাও”। তারা ছুটে পালিয়ে গেল। আমার পাকবাহিনীর কথা মনে হল। তারাও বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভক্ত করতে এমনি সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়েছিল। পার্থক্য তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিত আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা ভণ্ডামির আশ্রয় নিচ্ছে।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কলিমদ্দি ও মােস্তফাসহ ২০ জন হিন্দু যুবককে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হল । ৩ জন ছাড়া এরা সবাই জেলে। মাছ মেরে কোন রকমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। আর তাদের মা-বাপ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা আকুল হয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল । সে এক মর্মবিদারী করুণ দৃশ্য। সন্ধ্যার সময় কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ নাগ ও হরিপদ ঘােষ ছাড়া বাকি সবাই গ্রামে ফিরে এল । আমি গেলাম তাদের দেখতে। দেখলাম সবাই চলতে অক্ষম। সর্বাঙ্গ তাদের ফুলে গিয়েছে। বেত ও চাবুকের দাগ শরীরে কেটে কেটে বসে গেছে। চোখ মুখ ফোলা। হাত-পায়ের গিরাতে রক্ত জমে আছে। তাদের কাছে শুনলাম সারা দিন তাদের দফায় দফায় চাবুক মেরেছে। গলা ও পায়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে বার বার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুবিয়েছে। পিঠের নিচে ও বুকের উপর বাধ দিয়ে দুদিক থেকে দু’জন লােক তাদের উপর উঠে দাড়িয়েছে। মই দিয়ে চলেছে। এদের কাউকে ওদের আত্মীয়রা গিয়ে বয়ে এনেছে। অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম যারা দিনরাত্রি পরিশ্রম করেও আজ একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, অনাহার, দুঃখ, দারিদ্র্যের জ্বালায় আজ অর্ধমৃত, তাদের “মরার উপর খাড়ার ঘা”র কবে অবসান হবে। যে শাসকরা মানুষের সামান্য প্রয়ােজন, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না; চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দুঃশাষণ, নির্যাতন যারা বন্ধ করতে পারছে না, তারা কোন অধিকারে আজ নিঃস্ব মানুষের উপর চালাচ্ছে এই বর্বর নির্যাতন।
অবশেষে চরম নির্যাতন আমার ওপরও নেমে এল।
৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) রাত্রি ভাের না হতেই রক্ষীবাহিনী আমাকে ঘুম থেকে তুলল। আমাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এলে দেখলাম সেখানে রীনা সিনহাও রয়েছে। আমাদের নিয়ে তারা প্রায় দুই মাইল দূরে ভেদরগঞ্জ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হল। রাস্তায় রীনার প্রতি তারা নানা অশ্লীল উক্তি করছিল। ক্যাম্পে পৌছে দেখলাম সেখানে কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ নাগ ও হরিপদ ঘােষও রয়েছে। চেহারা দেখেই বােঝা গেল তাদের উপর গুরুতর দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে। বিশেষ করে কলিমদ্দি ও মােস্তফাকেই বেশি অসুস্থ দেখলাম। কলিমদ্দি, মােস্তফা- দুই ভাই; এদের সংসারে আর কোন সক্ষম ব্যক্তি নেই। অপরের জমি চাষ করে এরা কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের রয়েছে স্ত্রী ও ছােট ছােট ছেলেমেয়ে।
আমরা ক্যাম্পে আসতেই অনেক রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালাে। শুরু হল রীনার উপর অপমান বৃষ্টি। কেউ অশ্লীল মন্তব্য করে, কেউ চুল ধরে টানে, কেউ চড় মারে, কেউ খোঁচা দেয়, এমনি সব বর্বরতা। কিছুক্ষণ পর আমাদের রৌদ্রের মধ্যে বসিয়ে
রেখে তারা চলে গেল। সন্ধ্যায় আমাদের একটি কামরায় ঢুকালাে। অনেক রাত্রিতে রীনাকে তারা উপরের দোতলায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম রীনার হৃদয়বিদারী চিৎকার। প্রায় আধ ঘণ্টা পর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে থেমে গেল। নিস্তব্ধ রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে রীনাকে যখন তারা এনে কামরার মধ্যে ফেলল, রাত্রি তখন কত জানি না। রীনার অর্ধচেতন দেহ বেতের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত ঝরছে। রীনার জ্ঞান এলে পানি চাইল। আমি তাকে পানি খাওয়ালাম। রীনা আস্তে আস্তে কথা বলতে পারলাে। রাত্রি তখন ভাের হয়ে এসেছে। রীনার মুখে শুনলাম উপরে ভেদরগঞ্জ ও ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সম্পাদকরা এবং এই দুই স্থানের ক্যাম্প কমান্ডাররা উপস্থিত ছিল। তারা শান্তি সেন ও চঞ্চল কোথায় আছে, তাদের ধরিয়ে দিতে বলে এবং অস্ত্র কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করে। রীনা কিছুই জানে না বলায় তাকে এমন সব অশ্লীল কথা বলে যা কোন সভ্য মানুষের পক্ষে বলা তাে দূরের কথা, কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসা ও গালিবর্ষণের পর ভেদরগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডার বেত নিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এলােপাথাড়ি এমন পিটাতে থাকে যে পরপর তিনখানা বেত ভেঙে যায়। আবার জিজ্ঞাসা করে শান্তি সেন ও চঞ্চল কোথায়? অস্ত্র কোথায়? রীনার একই উত্তর। ক্ষিপ্ত হয়ে রীনাকে তারা সিলিং-এর সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় এবং দুই কমান্ডার দুইদিক থেকে একসঙ্গে চাবুক চালাতে থাকে। মারার সময় রীনা বলেছিল “আমাকে এভাবে না মেরে একেবারে গুলি করে মেরে ফেলুন।” জবাবে তারা বলে, “সরকারের একটা গুলির দাম আছে তােকে সাতদিন ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলব। এখন পর্যন্ত মারার হয়েছে কি?” অল্প পরেই রীনা অচেতন হয়ে যায়। কিন্তু তারা ঐ দেহের উপরই চাবুক চালাতে থাকে। জ্ঞান এলে রীনা দেখে যে সে মেঝের উপর পড়ে আছে। পানি চাইলে তাকে পানিও দেওয়া হয়নি।
৮ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম আমাকে এবং পরে রীনাকে দোতলায় নেয়া হয়। সেখানে দেখলাম ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী ফজলু মিয়া ও ভেদরগঞ্জের সেক্রেটারী হােসেন খাঁ চেম্বারে বসে আছে। আমাকে বলল, তােমার স্বামী ও ছেলেকে ধরিয়ে দাও। অস্ত্র কোথায় আছে বলে দাও । তারা ডাকাত, অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে। আমি বলি, তারা ডাকাত নয়, তারা সৎ, দেশপ্রেমিক । আমার স্বামী রাজনীতি করেন-একথা কে না জানে। তিনি এ দেশের সাধারণ লােকের অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়।’ রীনাকেও তারা একই প্রশ্ন করে। রীনা জানে না বলায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ডামুড্যা ক্যাম্পের কমান্ডার করম আলী এবং ভেদরগঞ্জের ক্যাম্প কমান্ডার ফজলুর রহমান এরা সবাই আমাদের অশ্লীল গালাগালি দিতে থাকে এবং আমাকে ও রীনাকে একসঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে রীনার বস্ত্র খুলে নেয়। তারপর কমান্ডার দুজন দু’দিক থেকে চাবুক মারতে থাকে। আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমরা উভয়ে মেঝেতে পড়ে আছি। রীনার সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার গায়ে কাপড় থাকায় অপেক্ষাকৃত কম আহত হয়েছি। তবু এই রুগ্ন বৃদ্ধ দেহে এই আঘাতই মর্মান্তিক। সর্বাঙ্গ ব্যথায় জর্জরিত। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। নড়বার ক্ষমতা নেই। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে নারকীয় হাসি হাসছে। ওদের হুকুমে দু’জন সিপাই আমাকে টেনে তুলল। আমি অতি কষ্টে দাঁড়াতে পারলাম। রীনা পারল না। দু’জন রক্ষী তার দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলে তার গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিল ও টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে এল। কমান্ডার পিছন থেকে নির্দেশ দেয়, “ওটাকে ভালাে করে হাঁটা, নয়ত মরে যাবে।” সকালে কমান্ডার কয়েকজন রক্ষী সিপাইসহ রীনাকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওয়ানা হল। বলল, “বাঁচবি তাে না, চল তাের মাকে দেখিয়ে আনি।”
রীনার সর্বাঙ্গ ফুলে কালাে হয়ে গিয়েছে। একটি পা ফেলবার ক্ষমতা নেই। সে অবস্থায় তাকে দু’বাহুতে ধরে দু’জন রক্ষী প্রায় টানতে টানতে দু’মাইল দুরে বাড়ির দিকে নিয়ে চললাে। ঠাট্টা করে বলছিল, “হাঁটলে গা ব্যথা কমে যাবে।” বাড়িতে নিয়ে রীনার মা তাকে দেখেই ফিট হয়ে যান। কমান্ডার রীনাকে তার মার মাথায় পানিতে দিতে বলে। রীনার মার জ্ঞান এলে, রীনার চেহারা এমন কেন জিজ্ঞেস করায় কমান্ডার বলে, “পুকুর ঘাটে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে।” রীনাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রীনার মা কমান্ডারের কাছে অনুনয় করলে কমান্ডার বলে, “খাসি খাওয়ালে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।” রীনাকে তারা দু’মাইল রাস্তা পুনরায় টানতে টানতে নিয়ে এল। ঐ দিন ছিল ৯ ফেব্রুয়ারী। হনুফাকেও তারা ধরে নিয়ে এল ঐদিন । করিম নামে আরেকটি কৃষক যুবককেও তারা রামভদ্রপুর থেকে এনেছে দেখলাম। তাকে এতাে মেরেছে যে অবস্থা তার সঙ্গীন। নড়িয়া থানার পণ্ডিতসার থেকেও একজন স্কুল শিক্ষক ও দুজন যুবককে এনেছে দেখলাম। বিপ্লব নামে একটি ছেলে নাকি মারের চোটে পথেই মারা যায়। রক্ষীবাহিনীর সিপাইরা বলাবলি করছিল। একজন জল্লাদ গর্ব করে বলছিল, দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে। শুনেছি মতি নামে আর একটি যুবককেও তারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আর আমাদের ধরে আনার দু’একদিন আগে কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটাবার পর হাত পা বেঁধে দোতলার ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে।
নয় তারিখ দুপুরের অল্প পরে তারা হনুফা, রীনা ও আমাকে নিয়ে গেলে পুকুর ধারে। সেখানে আমাদের একদফা বেত দিয়ে পিটিয়ে চুবানাের জন্য পানিতে নামাল। প্রথম আমাদের ওরাই সাঁতরাতে বাধ্য করল । আমরা পথশ্রান্ত হয়ে কিনারায় উঠতে চেষ্টা করি, ওরা আমাদের বাঁশ দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিশ্রান্ত হয়ে যখন আমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না, তখন পানি থেকে তুলে আবার বেত মারতে থাকে। শেষের দিকে আমরা যখন সঁতরাতে পারছিলাম না, তখন আমাদের পানিতে ডুবিয়ে আমাদের দেহের উপর দু’পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকত। এমন তিনদফা আমাদের চুবানাে ও পেটানাে হয়। কিছুক্ষণ আগেই করিম মারের চোটে মরে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে আরাে একটি অল্প বয়সের যুবককেও চুবিয়ে অচেতন করে ফেলেছিল। তাকে ঘাটলার উপর ফেলে রাখে। আমার আঁচল দিয়ে গা মুছানাের সময় হঠাৎ ছেলেটি চোখ মেলে তাকায়। “মা আপনি কে?” বলে করুণ কণ্ঠে ডেকে ওঠে। আমি চোখের জল রাখতে পারলাম না। রক্ষীরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি, ছেলেটিকে নাকি মেরে ফেলেছে।
সন্ধ্যার অল্প আগে আমাদের পানি থেকে তুলে ভিজা কাপড়েই থাকতে বাধ্য করল। দারুণ শীতে আমরা কাঁপছি। প্রচণ্ড জ্বর এসে গেছে সকলের। এমনি করেই রাতভর ছালার চটের উপর পড়ে থাকলাম। পরদিন রাতে রীনাকে আবার নিয়ে গেলাে দোতলায়। সেখানে আবার তাকে ঝুলিয়ে বেত মারল। ১১ তারিখ রাতে আবার রীনার উপর চলল এই অত্যাচার। রীনা জ্ঞান হারাল। রক্ষী সিপাইদের বলাবলি করতে শুনলাম, রীনা মরে গিয়েছে। রীনার কাছে শুনলাম, তার যখন জ্ঞান হল তখন সে দেখে, তার পাশে ডাক্তার বসা। রীনা জিজ্ঞেস করে, আপনি কে, আমি কোথায়? ডাক্তার জবাব দেয়, আমি ডাক্তার, তুমি কথা বলাে না। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে গেলে রীনাকে তারা ধরাধরি করে নিচে আমাদের কাছে নিয়ে এলাে।
একজন সিপাই রীনা ও হনুফাকে বলে, তােরা তাে মরেই যাবি, তার আগে আমরা প্রতি রাতে পাঁচজন করে তােদের ভােগ করব। তারা অবশ্য ‘ভােগ’ শব্দটি বলে নাই। বলেছিল অতি অশ্লীল কথা। একদিন রাতে দুটি রক্ষী সিপাই ঘরে ঢুকে আলাে নিভিয়ে দেয়। রীনা ও হনুফার মুখ চেপে ধরে। ধ্বস্তাধস্তি করে তারা ছুটে গিয়ে চিৎকার করে। চিৎকার শুনে, ক্যাম্পের অন্য রক্ষীরা ছুটে আসে। কমান্ডারও আসে। ওরা তাকে সব বললে সে বলে, খবরদার একথা প্রকাশ করাে না, তাহলে মেরে ফেলবাে। রক্ষী সিপাইদের কারাে মধ্যে মাঝে মাঝে মানবতাবােধের লক্ষণ পাচ্ছিলাম। তারই একটি সিপাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছাে?” প্রশ্ন শুনে সে যেন চমকে উঠল। বলল, “বাংলাদেশে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমরা জল্লাদ, জল্লাদের আবার লেখাপড়ার দরকার কি?-এই বলে সে দে ছুট। মনে হল যেন চাবুক খেয়ে একটি ছাগল ছুটে পালাল। রক্ষী সিপাইদের কানাঘুষায় শুনছিলাম, আমাকে ও হনুফাকে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেবে, আর রীনা ও অন্যান্য পুরুষবন্দিদের মেরে ফেলা হবে।
১২ ফেব্রুয়ারি আমাকে ও হনুফাকে নিয়ে রক্ষীরা রওয়ানা দিল। আমরা রীনাকে ফেলে যেতে আপত্তি জানালাম। রীনাও আমাদের সঙ্গে যেতে খুব কান্নাকাটি করছিল, কমান্ডারের কাছে অনুনয় বিনয় করছিল। কমান্ডার তার সহকর্মীদের সঙ্গে কি যেন আলাপ করে সেদিন আমাদের পাঠানাে স্থগিত রাখলাে।
১২ তারিখেও ওরা রাত্রিতে আবার রীনাকে ঝুলিয়ে নিয়ে হান্টার দিয়ে পেটায়। ১৩ তারিখে তারা রীনাকে মারে না, কিন্তু নির্যাতনের নতুন কৌশল নেয়। দম বন্ধ করে রাখে, জোর করে ধরে নাকমুখ চেপে রাখে, এমনি করে জ্ঞান হারালে ওরা ছেড়ে দেয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ওরা আমাদের তিনজনকে নিয়েই রওয়ানা দিল প্রায় চার মাইল দূর ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ ও হরিপদ থেকে গেল। রক্ষীরা বলাবলি করছিল, তাদের মেরে ফেলা হবে। আমরা কিছু দূরে এলে ক্যাম্পের দিক থেকে চারবার গুলীর আওয়াজ শুনলাম। ভাবলাম ওদের বুঝি মেরে ফেললাে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। তার ওপর আমাদের শরীরের অবস্থা এমন ছিল যে হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবু আমরা বাধ্য হচ্ছিলাম হাটতে। বােধ হয় আমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে, বােধ হয় বেঁচে যাবাে। এই চিন্তাই আমাদের হাঁটতে শক্তি যােগাচ্ছিল। অনেক রাতে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে পৌছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ রেখে স্পীড বােটে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। সমস্তক্ষণ আমাদের কম্বল চাপ দিয়ে মুরদার মত ঢেকে রাখা হল। বেদনা-জর্জরিত ক্ষত-বিক্ষত শরীর। তার উপর গরমে কম্বল চাপা থেকে শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। যেন জ্যান্ত কবর। আমাদের মাদারীপুর রক্ষী ক্যাম্পে আনা হল। সেখানে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করল। সমস্ত দিন আমাদের ওখানেই রাখল। খেতে দিল না। শেষ রাতে জীপে করে আবার কম্বল চাপা দিয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা হল। আবার সেই সুদীর্ঘ পথ- জ্যান্ত কবরের যন্ত্রণা।
ঢাকায় আমাদের প্রথমে রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে গেল। সে আমাদের খুব ধমক লাগালাে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে গেল তেজগাঁ থানায়, তারপর লালবাগ থানায়। রাতে সেখানে থাকলাম। পরদিন পাঠাল সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে পাঁচদিন রাখার
পর আমাদের নিয়ে এল তেজগা কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা বিভাগের অফিসে। সেখানে পাঁচদিন রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পর আবার সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।
জেলে আমাদের তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কয়েদিদের মতাে রাখা হতাে। একই আহার্য দেওয়া হতাে। দিনরাত সেলে বলি। সেখানে রাজনৈতিক অভিযােগে আরও বন্দিনী আছেন। তার মধ্যে ১৭ মার্চ গ্রেফতার জাসদ নেত্রী মমতাজ বেগম আছেন। অস্ত্র আইনে সাজাপ্রাপ্ত পারভীন। আরাে একজন নাম রুমা- আছেন। সবাইকে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি করে রাখা হয়েছে এবং সাধারণ কয়েদিদের মতাে খাটুনীর কাজ করানাে হচ্ছে। এর উপর জমাদারনীরা (মেয়ে সিপাই জমাদার) তাদের নিজেদের জামা কাপড় সেলাই, কাঁথা সেলাই, কাপড়-চোপড় ধােয়ানাে সবকিছু মেয়ে কয়েদিদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দিনীদেরও রেহাই দিচ্ছে না।
এই বিবৃতিটি ছিল অরুণা সেনের দুর্ভোগের অতি সংক্ষিপ্তসার। অন্যত্র তিনি ঐ নিপীড়িত দিনগুলাের আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছেন :
…মাদারিপুর ক্যাম্পে আনার পর দেখি শেখ মণি বসে আছে। আসলে রীট হবার পর শেখ মুজিব নিজেও নজর রাখছিল ঘটনার উপর। তিনিই মণিকে মাদারিপুর পাঠিয়েছিলেন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। মণি আমাকে বৌদি সম্বােধন করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললাে।…রীনার ওপর কী ধরনের অত্যাচার হয়েছে জানতে চাইলাে।…পরদিন ঢাকা আনা হলাে।…দেড় মাস পর মুক্তি পেলাম। মুক্তি পেয়ে গােপন জীবনে চলে গেলাম। না হয় মরতে হতাে। আমাদের হত্যা করা হয়নি বলে আওয়ামী লীগের উচ্চমহল রক্ষীবাহিনীর উপর অসন্তুষ্ট ছিল।…
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ।
১৯৭৪ এর ১৭ মার্চ এই বিবৃতি প্রথম সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের জুনে তা ‘সংস্কৃতি’ নামে আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অরুণা সেন ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী। শান্তি সেন সাম্যবাদী দলের নেতা ছিলেন।
তার পুত্রের নাম ছিল চঞ্চল সেন। বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ভেদেরগঞ্জের রামভদ্রপুরে শান্তি সেনের জন্ম। রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যই অরুণা সেন রক্ষীবাহিনীর নিগ্রহের শিকার হন। তার নিমোক্ত বিবৃতি থেকে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের পদ্ধতিগত দিক সম্পর্কে বিশেষ ধারণা পাওয়া যায়। ২০০৫ সালের ৫ জুন মিসেস অরুণা সেন মারা যান।
অরুণা সেন-এর বিবৃতি
গত ১৭ আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লােকেরা আমাদের গ্রামের উপর হামলা করে। ঐদিন ছিল হিন্দুদের দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। খুব ভােরেই আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে মারপিট করে তারা। লক্ষণ নামে কলেজের এক ছাত্র এবং আমাকে তারা নড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী শান্তি সেন এবং পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের ধরিয়ে দিন। আরাে জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। লক্ষণকে সেদিন রেখে পরদিন ছেড়ে দেয়। সে যখন বাড়ি ফিরে, দেখি মারধােরের ফলে সে গুরুতর অসুস্থ। চার পাঁচদিন পর আবার তারা রাত্রিতে গ্রামের উপর হামলা করে। অনেক বাড়ি তল্লাশি করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামে দুই যুবককে মারতে মারতে নিয়ে যায়। আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। তাদের আত্মীয়রা ক্যাম্পে গেলে বলে দিয়েছে। সেখানে নেই। তাদের মেরে ফেলেছে বলেই মনে হয়। এরপর থেকে রক্ষীবাহিনী মাঝে মাঝেই গ্রামে এসে যুবকদের খোঁজ করত। কিন্তু তেমন কোনাে ব্যাপক হামলা হয়নি।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত্রি থাকতে এসে রক্ষীবাহিনীর বিরাট একটি দল আমাদের সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ঘিরে ফেলল। ভােরে আমাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম গ্রামের প্রায় অধিকাংশ সক্ষমদেহী পুরুষ উপস্থিত- এমনকি বালকদের পর্যন্ত এনে হাজির করেছে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হােসেন খাঁ তদারক করছে সব। আমার সামনে রক্ষীবাহিনী উপস্থিত সকলকে বেদম মারপিট করে। শুনলাম এদের সকলকে ধরতে গিয়ে বাড়ির মেয়েদেরও প্রচণ্ড মারপিট করেছে এবং অশ্লীল আচরণ করছে। তাদের একদফা মারপিট করে রক্ষীরা আমাকে বললাে পানিতে নেমে দাঁড়াতে। সেখানে নাকি আমাকে গুলি করা হবে। আমি নিজেই পানির দিকে নেমে গেলাম। কিন্তু নদীর পানি দূরে সরে যাওয়ায়, হাঁটু সমান কাদাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওরা তাক করে রাইফেল ধরল গুলি করবে বলে। কিন্তু পরস্পর কি যেন বলাবলি করে রাইফেল নামিয়ে নিল। কাদার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। কমান্ডার গ্রেফতার করা লােকদের হিন্দু-মুসলিম দুই ভাগ করে দুই কাতারে দাঁড় করালাে। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বললাে, “মালাউনরা আমাদের দুশমন। তাদের ক্ষমা করা হবে না। তােমরা মুসলমানরা মালাউনদের সাথে থেকো না। তােমাদের এবারকার মতাে মাফ করে দেওয়া হল।” এই বলে কলিমদ্দি ও মােস্তফা নামে দু’জন মুসলমান যুবককে রেখে আর সবাইকে এক এক বেতের বাড়ি দিয়ে বললাে, “ছুটে পালাও”। তারা ছুটে পালিয়ে গেল। আমার পাকবাহিনীর কথা মনে হল। তারাও বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভক্ত করতে এমনি সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়েছিল। পার্থক্য তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিত আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা ভণ্ডামির আশ্রয় নিচ্ছে।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কলিমদ্দি ও মােস্তফাসহ ২০ জন হিন্দু যুবককে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হল । ৩ জন ছাড়া এরা সবাই জেলে। মাছ মেরে কোন রকমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। আর তাদের মা-বাপ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা আকুল হয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল । সে এক মর্মবিদারী করুণ দৃশ্য। সন্ধ্যার সময় কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ নাগ ও হরিপদ ঘােষ ছাড়া বাকি সবাই গ্রামে ফিরে এল । আমি গেলাম তাদের দেখতে। দেখলাম সবাই চলতে অক্ষম। সর্বাঙ্গ তাদের ফুলে গিয়েছে। বেত ও চাবুকের দাগ শরীরে কেটে কেটে বসে গেছে। চোখ মুখ ফোলা। হাত-পায়ের গিরাতে রক্ত জমে আছে। তাদের কাছে শুনলাম সারা দিন তাদের দফায় দফায় চাবুক মেরেছে। গলা ও পায়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে বার বার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুবিয়েছে। পিঠের নিচে ও বুকের উপর বাধ দিয়ে দুদিক থেকে দু’জন লােক তাদের উপর উঠে দাড়িয়েছে। মই দিয়ে চলেছে। এদের কাউকে ওদের আত্মীয়রা গিয়ে বয়ে এনেছে। অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম যারা দিনরাত্রি পরিশ্রম করেও আজ একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, অনাহার, দুঃখ, দারিদ্র্যের জ্বালায় আজ অর্ধমৃত, তাদের “মরার উপর খাড়ার ঘা”র কবে অবসান হবে। যে শাসকরা মানুষের সামান্য প্রয়ােজন, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না; চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দুঃশাষণ, নির্যাতন যারা বন্ধ করতে পারছে না, তারা কোন অধিকারে আজ নিঃস্ব মানুষের উপর চালাচ্ছে এই বর্বর নির্যাতন।
অবশেষে চরম নির্যাতন আমার ওপরও নেমে এল।
৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) রাত্রি ভাের না হতেই রক্ষীবাহিনী আমাকে ঘুম থেকে তুলল। আমাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এলে দেখলাম সেখানে রীনা সিনহাও রয়েছে। আমাদের নিয়ে তারা প্রায় দুই মাইল দূরে ভেদরগঞ্জ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হল। রাস্তায় রীনার প্রতি তারা নানা অশ্লীল উক্তি করছিল। ক্যাম্পে পৌছে দেখলাম সেখানে কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ নাগ ও হরিপদ ঘােষও রয়েছে। চেহারা দেখেই বােঝা গেল তাদের উপর গুরুতর দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে। বিশেষ করে কলিমদ্দি ও মােস্তফাকেই বেশি অসুস্থ দেখলাম। কলিমদ্দি, মােস্তফা- দুই ভাই; এদের সংসারে আর কোন সক্ষম ব্যক্তি নেই। অপরের জমি চাষ করে এরা কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের রয়েছে স্ত্রী ও ছােট ছােট ছেলেমেয়ে।
আমরা ক্যাম্পে আসতেই অনেক রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালাে। শুরু হল রীনার উপর অপমান বৃষ্টি। কেউ অশ্লীল মন্তব্য করে, কেউ চুল ধরে টানে, কেউ চড় মারে, কেউ খোঁচা দেয়, এমনি সব বর্বরতা। কিছুক্ষণ পর আমাদের রৌদ্রের মধ্যে বসিয়ে
রেখে তারা চলে গেল। সন্ধ্যায় আমাদের একটি কামরায় ঢুকালাে। অনেক রাত্রিতে রীনাকে তারা উপরের দোতলায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম রীনার হৃদয়বিদারী চিৎকার। প্রায় আধ ঘণ্টা পর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে থেমে গেল। নিস্তব্ধ রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে রীনাকে যখন তারা এনে কামরার মধ্যে ফেলল, রাত্রি তখন কত জানি না। রীনার অর্ধচেতন দেহ বেতের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত ঝরছে। রীনার জ্ঞান এলে পানি চাইল। আমি তাকে পানি খাওয়ালাম। রীনা আস্তে আস্তে কথা বলতে পারলাে। রাত্রি তখন ভাের হয়ে এসেছে। রীনার মুখে শুনলাম উপরে ভেদরগঞ্জ ও ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সম্পাদকরা এবং এই দুই স্থানের ক্যাম্প কমান্ডাররা উপস্থিত ছিল। তারা শান্তি সেন ও চঞ্চল কোথায় আছে, তাদের ধরিয়ে দিতে বলে এবং অস্ত্র কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করে। রীনা কিছুই জানে না বলায় তাকে এমন সব অশ্লীল কথা বলে যা কোন সভ্য মানুষের পক্ষে বলা তাে দূরের কথা, কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসা ও গালিবর্ষণের পর ভেদরগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডার বেত নিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এলােপাথাড়ি এমন পিটাতে থাকে যে পরপর তিনখানা বেত ভেঙে যায়। আবার জিজ্ঞাসা করে শান্তি সেন ও চঞ্চল কোথায়? অস্ত্র কোথায়? রীনার একই উত্তর। ক্ষিপ্ত হয়ে রীনাকে তারা সিলিং-এর সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় এবং দুই কমান্ডার দুইদিক থেকে একসঙ্গে চাবুক চালাতে থাকে। মারার সময় রীনা বলেছিল “আমাকে এভাবে না মেরে একেবারে গুলি করে মেরে ফেলুন।” জবাবে তারা বলে, “সরকারের একটা গুলির দাম আছে তােকে সাতদিন ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলব। এখন পর্যন্ত মারার হয়েছে কি?” অল্প পরেই রীনা অচেতন হয়ে যায়। কিন্তু তারা ঐ দেহের উপরই চাবুক চালাতে থাকে। জ্ঞান এলে রীনা দেখে যে সে মেঝের উপর পড়ে আছে। পানি চাইলে তাকে পানিও দেওয়া হয়নি।
৮ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম আমাকে এবং পরে রীনাকে দোতলায় নেয়া হয়। সেখানে দেখলাম ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী ফজলু মিয়া ও ভেদরগঞ্জের সেক্রেটারী হােসেন খাঁ চেম্বারে বসে আছে। আমাকে বলল, তােমার স্বামী ও ছেলেকে ধরিয়ে দাও। অস্ত্র কোথায় আছে বলে দাও । তারা ডাকাত, অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে। আমি বলি, তারা ডাকাত নয়, তারা সৎ, দেশপ্রেমিক । আমার স্বামী রাজনীতি করেন-একথা কে না জানে। তিনি এ দেশের সাধারণ লােকের অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়।’ রীনাকেও তারা একই প্রশ্ন করে। রীনা জানে না বলায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ডামুড্যা ক্যাম্পের কমান্ডার করম আলী এবং ভেদরগঞ্জের ক্যাম্প কমান্ডার ফজলুর রহমান এরা সবাই আমাদের অশ্লীল গালাগালি দিতে থাকে এবং আমাকে ও রীনাকে একসঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে রীনার বস্ত্র খুলে নেয়। তারপর কমান্ডার দুজন দু’দিক থেকে চাবুক মারতে থাকে। আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমরা উভয়ে মেঝেতে পড়ে আছি। রীনার সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার গায়ে কাপড় থাকায় অপেক্ষাকৃত কম আহত হয়েছি। তবু এই রুগ্ন বৃদ্ধ দেহে এই আঘাতই মর্মান্তিক। সর্বাঙ্গ ব্যথায় জর্জরিত। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। নড়বার ক্ষমতা নেই। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে নারকীয় হাসি হাসছে। ওদের হুকুমে দু’জন সিপাই আমাকে টেনে তুলল। আমি অতি কষ্টে দাঁড়াতে পারলাম। রীনা পারল না। দু’জন রক্ষী তার দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলে তার গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিল ও টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে এল। কমান্ডার পিছন থেকে নির্দেশ দেয়, “ওটাকে ভালাে করে হাঁটা, নয়ত মরে যাবে।” সকালে কমান্ডার কয়েকজন রক্ষী সিপাইসহ রীনাকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওয়ানা হল। বলল, “বাঁচবি তাে না, চল তাের মাকে দেখিয়ে আনি।”
রীনার সর্বাঙ্গ ফুলে কালাে হয়ে গিয়েছে। একটি পা ফেলবার ক্ষমতা নেই। সে অবস্থায় তাকে দু’বাহুতে ধরে দু’জন রক্ষী প্রায় টানতে টানতে দু’মাইল দুরে বাড়ির দিকে নিয়ে চললাে। ঠাট্টা করে বলছিল, “হাঁটলে গা ব্যথা কমে যাবে।” বাড়িতে নিয়ে রীনার মা তাকে দেখেই ফিট হয়ে যান। কমান্ডার রীনাকে তার মার মাথায় পানিতে দিতে বলে। রীনার মার জ্ঞান এলে, রীনার চেহারা এমন কেন জিজ্ঞেস করায় কমান্ডার বলে, “পুকুর ঘাটে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে।” রীনাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রীনার মা কমান্ডারের কাছে অনুনয় করলে কমান্ডার বলে, “খাসি খাওয়ালে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।” রীনাকে তারা দু’মাইল রাস্তা পুনরায় টানতে টানতে নিয়ে এল। ঐ দিন ছিল ৯ ফেব্রুয়ারী। হনুফাকেও তারা ধরে নিয়ে এল ঐদিন । করিম নামে আরেকটি কৃষক যুবককেও তারা রামভদ্রপুর থেকে এনেছে দেখলাম। তাকে এতাে মেরেছে যে অবস্থা তার সঙ্গীন। নড়িয়া থানার পণ্ডিতসার থেকেও একজন স্কুল শিক্ষক ও দুজন যুবককে এনেছে দেখলাম। বিপ্লব নামে একটি ছেলে নাকি মারের চোটে পথেই মারা যায়। রক্ষীবাহিনীর সিপাইরা বলাবলি করছিল। একজন জল্লাদ গর্ব করে বলছিল, দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে। শুনেছি মতি নামে আর একটি যুবককেও তারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আর আমাদের ধরে আনার দু’একদিন আগে কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটাবার পর হাত পা বেঁধে দোতলার ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে।
নয় তারিখ দুপুরের অল্প পরে তারা হনুফা, রীনা ও আমাকে নিয়ে গেলে পুকুর ধারে। সেখানে আমাদের একদফা বেত দিয়ে পিটিয়ে চুবানাের জন্য পানিতে নামাল। প্রথম আমাদের ওরাই সাঁতরাতে বাধ্য করল । আমরা পথশ্রান্ত হয়ে কিনারায় উঠতে চেষ্টা করি, ওরা আমাদের বাঁশ দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিশ্রান্ত হয়ে যখন আমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না, তখন পানি থেকে তুলে আবার বেত মারতে থাকে। শেষের দিকে আমরা যখন সঁতরাতে পারছিলাম না, তখন আমাদের পানিতে ডুবিয়ে আমাদের দেহের উপর দু’পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকত। এমন তিনদফা আমাদের চুবানাে ও পেটানাে হয়। কিছুক্ষণ আগেই করিম মারের চোটে মরে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে আরাে একটি অল্প বয়সের যুবককেও চুবিয়ে অচেতন করে ফেলেছিল। তাকে ঘাটলার উপর ফেলে রাখে। আমার আঁচল দিয়ে গা মুছানাের সময় হঠাৎ ছেলেটি চোখ মেলে তাকায়। “মা আপনি কে?” বলে করুণ কণ্ঠে ডেকে ওঠে। আমি চোখের জল রাখতে পারলাম না। রক্ষীরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি, ছেলেটিকে নাকি মেরে ফেলেছে।
সন্ধ্যার অল্প আগে আমাদের পানি থেকে তুলে ভিজা কাপড়েই থাকতে বাধ্য করল। দারুণ শীতে আমরা কাঁপছি। প্রচণ্ড জ্বর এসে গেছে সকলের। এমনি করেই রাতভর ছালার চটের উপর পড়ে থাকলাম। পরদিন রাতে রীনাকে আবার নিয়ে গেলাে দোতলায়। সেখানে আবার তাকে ঝুলিয়ে বেত মারল। ১১ তারিখ রাতে আবার রীনার উপর চলল এই অত্যাচার। রীনা জ্ঞান হারাল। রক্ষী সিপাইদের বলাবলি করতে শুনলাম, রীনা মরে গিয়েছে। রীনার কাছে শুনলাম, তার যখন জ্ঞান হল তখন সে দেখে, তার পাশে ডাক্তার বসা। রীনা জিজ্ঞেস করে, আপনি কে, আমি কোথায়? ডাক্তার জবাব দেয়, আমি ডাক্তার, তুমি কথা বলাে না। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে গেলে রীনাকে তারা ধরাধরি করে নিচে আমাদের কাছে নিয়ে এলাে।
একজন সিপাই রীনা ও হনুফাকে বলে, তােরা তাে মরেই যাবি, তার আগে আমরা প্রতি রাতে পাঁচজন করে তােদের ভােগ করব। তারা অবশ্য ‘ভােগ’ শব্দটি বলে নাই। বলেছিল অতি অশ্লীল কথা। একদিন রাতে দুটি রক্ষী সিপাই ঘরে ঢুকে আলাে নিভিয়ে দেয়। রীনা ও হনুফার মুখ চেপে ধরে। ধ্বস্তাধস্তি করে তারা ছুটে গিয়ে চিৎকার করে। চিৎকার শুনে, ক্যাম্পের অন্য রক্ষীরা ছুটে আসে। কমান্ডারও আসে। ওরা তাকে সব বললে সে বলে, খবরদার একথা প্রকাশ করাে না, তাহলে মেরে ফেলবাে। রক্ষী সিপাইদের কারাে মধ্যে মাঝে মাঝে মানবতাবােধের লক্ষণ পাচ্ছিলাম। তারই একটি সিপাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছাে?” প্রশ্ন শুনে সে যেন চমকে উঠল। বলল, “বাংলাদেশে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমরা জল্লাদ, জল্লাদের আবার লেখাপড়ার দরকার কি?-এই বলে সে দে ছুট। মনে হল যেন চাবুক খেয়ে একটি ছাগল ছুটে পালাল। রক্ষী সিপাইদের কানাঘুষায় শুনছিলাম, আমাকে ও হনুফাকে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেবে, আর রীনা ও অন্যান্য পুরুষবন্দিদের মেরে ফেলা হবে।
১২ ফেব্রুয়ারি আমাকে ও হনুফাকে নিয়ে রক্ষীরা রওয়ানা দিল। আমরা রীনাকে ফেলে যেতে আপত্তি জানালাম। রীনাও আমাদের সঙ্গে যেতে খুব কান্নাকাটি করছিল, কমান্ডারের কাছে অনুনয় বিনয় করছিল। কমান্ডার তার সহকর্মীদের সঙ্গে কি যেন আলাপ করে সেদিন আমাদের পাঠানাে স্থগিত রাখলাে।
১২ তারিখেও ওরা রাত্রিতে আবার রীনাকে ঝুলিয়ে নিয়ে হান্টার দিয়ে পেটায়। ১৩ তারিখে তারা রীনাকে মারে না, কিন্তু নির্যাতনের নতুন কৌশল নেয়। দম বন্ধ করে রাখে, জোর করে ধরে নাকমুখ চেপে রাখে, এমনি করে জ্ঞান হারালে ওরা ছেড়ে দেয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ওরা আমাদের তিনজনকে নিয়েই রওয়ানা দিল প্রায় চার মাইল দূর ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। কলিমদ্দি, মােস্তফা, গােবিন্দ ও হরিপদ থেকে গেল। রক্ষীরা বলাবলি করছিল, তাদের মেরে ফেলা হবে। আমরা কিছু দূরে এলে ক্যাম্পের দিক থেকে চারবার গুলীর আওয়াজ শুনলাম। ভাবলাম ওদের বুঝি মেরে ফেললাে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। তার ওপর আমাদের শরীরের অবস্থা এমন ছিল যে হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবু আমরা বাধ্য হচ্ছিলাম হাটতে। বােধ হয় আমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে, বােধ হয় বেঁচে যাবাে। এই চিন্তাই আমাদের হাঁটতে শক্তি যােগাচ্ছিল। অনেক রাতে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে পৌছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ রেখে স্পীড বােটে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। সমস্তক্ষণ আমাদের কম্বল চাপ দিয়ে মুরদার মত ঢেকে রাখা হল। বেদনা-জর্জরিত ক্ষত-বিক্ষত শরীর। তার উপর গরমে কম্বল চাপা থেকে শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। যেন জ্যান্ত কবর। আমাদের মাদারীপুর রক্ষী ক্যাম্পে আনা হল। সেখানে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করল। সমস্ত দিন আমাদের ওখানেই রাখল। খেতে দিল না। শেষ রাতে জীপে করে আবার কম্বল চাপা দিয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা হল। আবার সেই সুদীর্ঘ পথ- জ্যান্ত কবরের যন্ত্রণা।
ঢাকায় আমাদের প্রথমে রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে গেল। সে আমাদের খুব ধমক লাগালাে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে গেল তেজগাঁ থানায়, তারপর লালবাগ থানায়। রাতে সেখানে থাকলাম। পরদিন পাঠাল সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে পাঁচদিন রাখার
পর আমাদের নিয়ে এল তেজগা কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা বিভাগের অফিসে। সেখানে পাঁচদিন রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পর আবার সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।
জেলে আমাদের তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কয়েদিদের মতাে রাখা হতাে। একই আহার্য দেওয়া হতাে। দিনরাত সেলে বলি। সেখানে রাজনৈতিক অভিযােগে আরও বন্দিনী আছেন। তার মধ্যে ১৭ মার্চ গ্রেফতার জাসদ নেত্রী মমতাজ বেগম আছেন। অস্ত্র আইনে সাজাপ্রাপ্ত পারভীন। আরাে একজন নাম রুমা- আছেন। সবাইকে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি করে রাখা হয়েছে এবং সাধারণ কয়েদিদের মতাে খাটুনীর কাজ করানাে হচ্ছে। এর উপর জমাদারনীরা (মেয়ে সিপাই জমাদার) তাদের নিজেদের জামা কাপড় সেলাই, কাঁথা সেলাই, কাপড়-চোপড় ধােয়ানাে সবকিছু মেয়ে কয়েদিদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দিনীদেরও রেহাই দিচ্ছে না।
এই বিবৃতিটি ছিল অরুণা সেনের দুর্ভোগের অতি সংক্ষিপ্তসার। অন্যত্র তিনি ঐ নিপীড়িত দিনগুলাের আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছেন :
…মাদারিপুর ক্যাম্পে আনার পর দেখি শেখ মণি বসে আছে। আসলে রীট হবার পর শেখ মুজিব নিজেও নজর রাখছিল ঘটনার উপর। তিনিই মণিকে মাদারিপুর পাঠিয়েছিলেন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। মণি আমাকে বৌদি সম্বােধন করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললাে।…রীনার ওপর কী ধরনের অত্যাচার হয়েছে জানতে চাইলাে।…পরদিন ঢাকা আনা হলাে।…দেড় মাস পর মুক্তি পেলাম। মুক্তি পেয়ে গােপন জীবনে চলে গেলাম। না হয় মরতে হতাে। আমাদের হত্যা করা হয়নি বলে আওয়ামী লীগের উচ্চমহল রক্ষীবাহিনীর উপর অসন্তুষ্ট ছিল।…
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ।