Sunday 11 August 2019

ঈদ-দুরন্ত শৈশব : স্মৃতির ঝাঁপি থেকে কিছু কথা।

ঈদ-দুরন্ত শৈশব : স্মৃতির ঝাঁপি থেকে কিছু কথা।

 ঈদ
বাঙালি জীবনাচরণের অন্যতম একটি অনুসঙ্গ উৎসব এবং ভাতৃত্ববোধের দিন।
হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের এক অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় প্রথা। কালের বিবর্তনে কিংবা বিশ্বায়নের প্রভাবে হয়তো আগের মতো ভাব গাম্ভীর্যের সাথে পালন করা হয়না। কিন্তু এই উৎসবটির বিশালতা এবং প্রভাব এতটুকু কমেনি।
গ্রামে বেড়ে উঠেছি আমি। ডানপিঠে শৈশবের দিনগুলো ছিল দুরন্ত আনন্দময় এবং নিষ্কণ্ঠক। সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কখন ঈদ আসবে কখন নতুন জামা কাপড় কিনবো। কুরবানীর ঈদে অপেক্ষায় থাকতাম গরু কেনার জন্য। আমার মা বলতেন রমজানের দুই মাস দশদিন পর কুরবানী আসবে। তারপর থেকে শুধু দিন গূনতাম কখন ঈদ আসবে চাচার সাথে বাজারে গিয়ে গরু কিনবো। কত অপেক্ষা কত প্রস্তুতি।

আমার শৈশব কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলোতে মনে হতো ঈদ মানে বিশাল কিছু। ঈদের প্রস্তুতি শুরু হতো অনেক আগে থেকেই। কুরবানীর জন্য আমার বাবা টাকা পাঠাতেন পনেরো বিশ দিন আগেই। ড্রাফট করে টাকা পাঠাতেন সৌদি আরব থেকে। রেজিষ্টারী চিঠি নিয়ে বাড়িতে ডাক পিয়ন আসা মানেই ড্রাফট এসেছে বলে ধারণা করা হতো। পিয়নকে দশ বিশ টাকা দেয়া হতো চা পানি খাওয়ার জন্য। এখন জীবন অনেক সহজ পাঁচ মিনিটে টাকা পাওয়া যায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। কিন্তু আমার বাবার পাঠানো সেই ড্রাফট সাথে পুত্রের প্রতি উপদেশমূলক চিঠির বিষয়বস্তু আজো আমাকে কর্তব্যপরায়ণ এবং নিষ্ঠাবান হওয়ার শিক্ষা দেয়। সততার ছিটেফোঁটাও যদি থাকে তবে সেটি পেয়েছি মা বাবার কাছ থেকে।

কয়েকটি পরিবার মিলে একসাথে কুরবানী করা হতো। আর্থিক সামর্থের কথা বিবেচনা করেই এটা করা হতো। মুরুব্বীরা বলতো "এবারে হাঁচ গিরি মিলি কোরবান দিমু" অর্থাৎ পাঁচ পরিবার মিলে একটি গরু কেনা হবে কুরবানীর জন্য। তারপর পাঁচ পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।

গরু কেনার জন্য বাজারে যাওয়া ছিল রীতিমতো এক উৎসব। আমার চাচার সাথে বাজারে যেতাম যাওয়ার সময় আমার মা কিছু টাকা দিতেন বুট কিংবা চানাচুর খাওয়ার জন্য। কোথাও যেতে গেলে মা অতিরিক্ত কিছু টাকা দিতেন এবং বলে দিতেন "খরচ করিসনা এই টাকা যদি বিশেষ দরকার না হয়।"

গরু বাজারে গিয়েই আমার চাচা প্রথমে চা খেতেন। তারপর আস্তে আস্তে গরু দেখতেন। গরুর লেজ ধরে, গরুর গায়ে থাপ্পড় মেরে এবং লেজ মোচড় দিয়ে "ভালো গরু" পরখ করতেন। গরু বাজারের দালাল সম্পর্কে তিনি সবসময় সতর্ক থাকতেন। তিনি যে গরুর সামনে থাকতেন সেই গরু যদি অন্য কেউ দরকষাকষি করতো তাহলে তিনি সেই গরু কিনতেননা। তিনি বলতেন এই লোকটি গরু বিক্রেতার নিয়োগ করা দালাল। আমরা ছোটরা বলতাম চাচা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। অতঃপর গরু কেনার বাড়িতে আসতাম। ছোটরা সবাই মিলে গরুর যত্নআত্তি নিতাম। কেউ ঘাস এনে দিচ্ছে,কেউ খড়, কেউবা ভাতের মাড়। চোরের ভয়ে উঠোনে গরু বাঁধা হতো রাতে বেশ কয়েকবার উঠে দেখতাম গরু আছে কিনা। বড়দের কাছে শুনেছিলাম ঈদের আগের রাতে বিশ/ত্রিশ বছর আগে আমাদের এলাকায় একবার গরু চুরি হয়েছিল। তাই এমন সতর্কতা।

ঈদের দুই তিন দিন আগে গরু কেনা হলে জবাই করার আগ পর্যন্ত সারাক্ষন আমরা গরুর সাথেই থাকতাম। বাড়ীর অন্য চাচাতো ভাইদের সাথে "কার গরু বড় কিংবা কার গরু ছোট" তা নিয়ে তর্কে লিপ্ত হতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ছাই দিয়ে দাঁত মাজতাম পুকুর পাড়ে, সেখানে অন্য সব চাচাতো ভাইদের সাথে আলাপ হতো কোরবানী নিয়ে। কোরবানী শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়ালেখায় আর মনোযোগ নেই। সারাক্ষন কোরবানী নিয়ে আলাপ আলোচনা, ছুরিতে শান দেয়া,গরুর শিং সংগ্রহ করা কিংবা গরুর কান্না বিষয়ে নিরন্তর আলোচনা।
একবার এক চাচাতো ভাই বলেছিলো গরুর চামড়া দিয়ে নাকি ঢোল বানানো যায়। ঢোল বানানোর লক্ষ্যে একবার গরুর মাথার চামড়া লবণ দিয়ে মাটিতে পুঁতে রেখেছিলাম। ঢোল আর বানানো হয়নি চামড়া পঁচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায়।

ঈদের দিন খুব সকালে উঠতাম। মায়ের বানানো নাস্তা খেয়ে ঈদগাহে ছুটতাম। নামাজে আমাদের মনোযোগ ছিলোনা। কখন গরু জবাই হবে সেই অপেক্ষায় থাকতাম। নামাজ শেষ করেই কবর জেয়ারত তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা মাঝে মাঝে রশি টেনে ধরতাম গরুকে শোয়ানোর প্রচেষ্টায়। চিৎকার চেঁচামেচি তে অন্যরকম এক আবহ তৈরী হতো। মাংস কাটাকুটিতে বড়দের সাহায্য করা ছিল আমাদের কাজ। মাংস ভাগ হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ জবাইয়ের পর পরই কলিজা বন্টন করে দেয়া হতো। কে কার আগে গরুর কলিজা খেয়েছে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো।

ঈদের দিনের অন্যতম আকর্ষণ বিটিভির অনুষ্ঠান। বাংলা সিনেমা নাটক এবং ইত্যাদি ছিল আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।

আমার মায়ের হাতের রান্না অমৃতসম। পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে এমন মনে হয়ে। আমার মা মাংস রান্না করে রাখতেন আমি কিছুক্ষন পর পর এসে এক টুকরো নিয়ে দৌঁড়ে আবার খেলতে যেতাম। আমার মা বলতেন "বৈ খা, এতো সুরভা খাছ কিল্লাই গোস্ত খা।" অর্থাৎ বসে খাও, ঝোল খেয়োনা মাংস খাও।

 বিকেলে নানা বাড়ী কিংবা খালার বাড়ী যাওয়া ছিল অন্যতম আনন্দের বিষয়। যাওয়ার সময় আমার মা টিফিন ক্যারিয়ারে চালের পিঠা এবং মাংস দিতেন। এই টিফিন ক্যারিয়ার আবার ফুফু, খালা এবং মামীরা রেখে দিতেন। পরদিন মামাতো ভাই, খালাতো ভাই কিংবা ফুফাতো ভাইয়েরা মাংস্ এবং পিঠা ভর্তি করে নিয়ে আসতেন। এসব রীতিনীতি গুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কৃত্রিমতা লোক দেখানো লৌকিকতায় ভরে গেছে মানুষের মন। খালা,ফুফুদের অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে ভালোবাসার মানুষগুলো।

দূর প্রবাসে ঈদের দিন ঈদ বলে মনে হয়না। কোনোকোনো ঈদের দিন কাজ থাকে। সকালে ঈদের নামাজ পরে কর্মের উদ্দেশ্যে আবার ছুটে চলা। ছুটে চলেছে হাজারো মানুষ।তবুও আমার মন পড়ে থাকে নিজের শিকড়ে নিজের অস্তিত্বে।
প্রিয় মানুষদের মুখে হাসি দেখতে এখন ভালো লাগে। নিজের জন্য কিছু কিনতে ইচ্ছে হয়না বরং আমার অর্জিত অর্থে ভালোবাসার মানুষেরা সুখে আছে ভাবতেই অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আবিষ্ট হয় মন প্রাণ। এ যেন স্বর্গীয় এক বন্ধন।
আলোর শহর ভালোবাসার শহর কিছুই আমাকে টানেনা। মন পাখি পরে থাকে ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের কোনো এক গ্রামে।  প্রিয় মানুষদের দেখার আকুলতা আমার ফুরোয়না, মনে হয়না কখনো ফুরাবে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রী দ্বিপ্রহর আরেকটি নতুন সকাল উদিত হওয়ার হাতছানি, ফরাসি দেশ আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে অর্থ-প্রাচুর্য তবুও বুকের কোথায় জানি শূন্য অনুভূত হয়। তবু কার লাগিয়া মন পোড়ে ?

কায়মনোবাক্যে আমার কামনা পৃথিবীর সব মানুষ ভালো থাকুক।

ঈদ মুবারক

Paris
11 sunday2019