ইউনেস্কোর আগের অবস্থান, ‘স্ট্রাটেজিক এনভায়ারমেন্টাল এসেসমেন্ট (এসইএ) সম্পন্ন হওয়ার আগে ওই এলাকায় বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো (রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ) নির্মাণের অনুমোদন না দেওয়া।’
ইউনেস্কোর এখনকার অবস্থান, ‘এসইএ সম্পন্ন হওয়ার আগে ওই এলাকায় বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন না দেওয়া।’ এর অর্থ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামটা এখন নেই, কিন্তু ‘বড় ধরনের শিল্প কারখানা’র অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি।
সরকারের বক্তব্য:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রথমে বলল, ‘ইউনেস্কো রামপালের উপর থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’ তারপর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন , ‘ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্পে কিছু শর্ত দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী বললেন, ‘সুন্দরবনের পাশে ‘আর’ কোনো ভারী শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণে সরকার অনুমোদন দিচ্ছে না। ইউনেস্কোর এই সুপারিশ ভবিষ্যতের অবকাঠামোর জন্যে বলা হয়েছে।’
ইউনেস্কোর অবস্থান আর সরকারের বক্তব্য:
ক. ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্প থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সরকারের এই বক্তব্যে ইউনেস্কোর বক্তব্য বা অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেনি।
খ. রামপাল প্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কোর শর্ত আগেও ছিল, এখনও আছে। সরকারের বক্তব্যের ধরন এমন যে, আগের ‘আপত্তি’ প্রত্যাহার করে এখন ‘শর্ত’ দিয়েছে, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। পূর্বের ‘আপত্তি-শর্ত’র ভাষাগত কিছু পরিবর্তন করেছে ইউনেস্কো।
গ. আগে ইউনেস্কোর আপত্তিতে রামপালের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ ছিল। এখন রামপালের কথা সুনির্দিষ্ট করে বলেনি। সরকারকে বলেছে ‘বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন না দিতে।’ এই অবস্থানকে সরকার বলছে, ইউনেস্কো রামপালের উপর থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রকৃত অর্থে, রামপাল প্রকল্পের উপর আরও জোরালো আপত্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ সুন্দরবনের পাশে শুধু রামপাল প্রকল্প নয়, আরও অনেক বড় শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছিল সরকার। রামপাল এবং সেইসব বড় শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও ক্ষতি হবে সুন্দরবনের। শুধু রামপাল নয়, সরকার যাতে কোনও বড় শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো সুন্দরবনের পাশে নির্মাণের উদ্যোগ না নেয়, অনুমোদন না দেয়- সে কারণে ‘আপত্তি’র পরিধি অনেক বিস্তৃত করা হয়েছে। ‘আপত্তি’ বা ‘শর্তে’ শুধু রামপালকে সুনির্দিষ্ট না করে, সকল অবকাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রামপালকে ‘আপত্তি’ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। আরও জোরালো ‘আপত্তি’ বা শর্তারোপ করা হয়েছে।
ঘ. সরকার ইউনেস্কোর বক্তব্য বা অবস্থানের ভেতরে অত্যন্ত সুকৌশলে একটি বাড়তি শব্দ ‘আর’ যোগ করেছে। বাড়তি একটি শব্দ ‘আর’ দিয়ে ইউনেস্কোর বক্তব্যের অর্থ প্রায় সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া হয়েছে। এটাকে কৌশল না বলে, চতুরতা বলাটা সম্ভবত বেশি যুক্তিপূর্ণ। ইউনেস্কোর বক্তব্যে সুন্দরবনের পাশে ‘বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো’ নির্মাণ না করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়নি, রামপাল প্রকল্পের কাজ চলবে। এও বলা হয়নি রামপাল বাদে ‘আর’ কোনো বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণ না করা বা নির্মাণের অনুমতি না দিতে।
সব ধরনের বড় শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণ না করার কথা যখন বলা হয়, তার মধ্যে রামপালও পরে। সুনির্দিষ্ট করে না বললে কোনো অর্থেই এটা বোঝায় না যে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে যার থেকে সেই রামপাল কয়ালাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলবে, কিন্তু অন্য কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।
২. রামপাল বিষয়ে অসত্য বা আংশিক অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্যের অবতারণা যে এই প্রথম করা হলো, তেমন নয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পরিবেশের ক্ষতি হবে না, আজকে পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি। অথচ সরকার প্রমাণ করতে মরিয়া যে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পরিবেশ বা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। সঠিক তথ্য দিয়ে তা যেহেতু প্রমাণ করা সম্ভব নয়, সেহেতু আংশিক সত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য হাজির করছে বারবার।
সরকার বিজ্ঞাপন বানিয়ে প্রচার করতে শুরু করল, পৃথিবীর ‘সর্বোচ্চ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রামপাল প্রকল্প নির্মাণ করা হবে।
‘সর্বোচ্চ’ প্রযুক্তি বলে পৃথিবীতে কোনো প্রযুক্তি নেই। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি বলতে বোঝানো হয় ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’কে। যদিও বর্তমানে ‘অ্যাডভান্স আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’র ব্যবহার আমেরিকা- ইউরোপের কোথাও কোথাও হচ্ছে। শুরু থেকে সরকার বলছিল, রামপাল প্রকল্প হবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে। হঠাৎ করে বিজ্ঞাপন বানানোর সময় ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’র কথা বাদ দিয়ে, ‘সর্বোচ্চ’ প্রযুক্তি শব্দ ব্যবহার করল কেন? প্রশ্নটি তখনই এসেছিল। উত্তর পাওয়া গেল তার কিছুদিন পর।
রামপাল প্রকল্প নির্মাণের বাংলাদেশ- ভারতের যৌথ কোম্পানি বিআইপিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভারতীয় নাগরিক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য উত্তর দিলেন পরিষ্কার করে, ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীতে নেই। মূলত সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণকে কেউ কেউ আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে থাকে।’
তাহলে আপনারা কেন আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের কথা এত দিন বলে এসেছেন—এ প্রশ্নের জবাবে উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘আপনাদের এখানে এত পণ্ডিত, এটি জানতাম না। রামপাল বিরোধিতাকারীরা না জেনেই এর বিরোধিতা করছে। আমাদের এত নাটক করার দরকার নেই। আপনাদের এখানে নাটকবাজি হয় বলে প্রথমে বলেছিলাম আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হবে।’ (২৯ অক্টোবর ২০১৬, কালের কণ্ঠ)
৩. তারপরও সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা বলা অব্যাহত রাখলেন, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই রামপাল প্রকল্প নির্মাণ করা হবে। ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই’- উজ্জ্বল কান্তির এই বক্তব্যও সঠিক নয়। এই প্রযুক্তি পৃথিবীতে বেশ কিছু বছর আগে থেকেই আছে।
কোম্পানির এমডির স্পষ্ট এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য অসম্মানজনক বক্তব্যের পরও, সরকার আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কথা বলতেই থাকলো। ইতিমধ্যে রামপাল প্রকল্পের প্রযুক্তি আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করল বিআইপিসিএল। সেই টেন্ডার পর্যালোচনা করে স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমামসহ আরও অনেকে দেখালেন, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি আমদানি করা হচ্ছে, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি নয়।
সুপার ক্রিটিক্যাল ৩০ বছর আগের প্রযুক্তি। আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতেও দূষণ হয়। তবে সুপার ক্রটিক্যাল প্রযুক্তি চেয়ে কম হয়।
৪. রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মিত হচ্ছে। আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির যুক্তি তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও, খুব বেশি কিছু যায় আসে না। ‘সুপার’ আর ‘আলট্রা’র মধ্যে দূষণের বেশি- কম ৪% থেকে ৫%। বিষয়টির অবতারণার কারণ যে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বারবার অসত্য তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। সরকার কাজটি হয়ত পরিকল্পিতভাবেই করছে। সর্বশেষ ইউনেস্কোর তথ্যের ক্ষেত্রেও তার প্রমাণ পাওয়া গেল।