প্রথমেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার ইচ্ছাকৃত কিঞ্চিত অসততার জন্যে। কেননা, এই নিবন্ধটার আরও যথার্থ শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘মডারেট ধার্মিক’। তবে আজ-কালকের বাজারে প্রচার মাধ্যমগুলোর বানিজ্যিক সফলতায় ‘মুসলিম’ শব্দটার গন্ধ থাকাটা এতটাই জরুরী ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, আমি নিজেও শব্দটার ব্যবহারে লোভ সামলাতে পারলাম না। যাহোক, এবার লেখার মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। আমার এক বন্ধু কথা প্রসঙ্গে আমাকে একবার বলেছিল, “মডারেট মুসলিম বলে আসলে কারো অস্তিত্ব নেই। এটা মুসলমানদেরকে ডিভাইড করার জন্যে পশ্চিমা দেশগুলোর এক ধরনের চক্রান্ত। কোর’আন একটাই।
মুসলমানও একরকম। কোর’আন যে মানে, সে মুসলমান; আর যে মানেনা সে না। ব্যাপারটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। ‘রেডিক্যাল মুসলিম’, ‘মডারেট মুসলিম’ ইত্যাদি গ্রুপে ভাগ করে ওরা মূলত মুসলিম উম্মাহকে ডিভাইড করতে চায় আমাদেরকে দূর্বল করার জন্যে। বুঝলি দোস্ত, এ সবই ঐ শালা পশ্চিমাদের চক্রান্ত”। খুবই জ্ঞানের কথা। বিষয়টা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুললো।
মুসলমানও একরকম। কোর’আন যে মানে, সে মুসলমান; আর যে মানেনা সে না। ব্যাপারটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। ‘রেডিক্যাল মুসলিম’, ‘মডারেট মুসলিম’ ইত্যাদি গ্রুপে ভাগ করে ওরা মূলত মুসলিম উম্মাহকে ডিভাইড করতে চায় আমাদেরকে দূর্বল করার জন্যে। বুঝলি দোস্ত, এ সবই ঐ শালা পশ্চিমাদের চক্রান্ত”। খুবই জ্ঞানের কথা। বিষয়টা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুললো।
‘মডারেট মুসলিম’ বলে সত্যিই কি কারো অস্তিত্ব আছে? শুনে হয়ত আমাদের অনেকের কাছে খারাপ লাগবে, কিন্তু তত্ত্বগতভাবে আসলেই নেই। অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিমত সেটাই। সে অর্থে আমার বন্ধুর দাবী অংশবিশেষে যেমন সত্যি, ঠিক তেমনই সত্যি আক্রমনাত্বক মন্তব্যকারী পাঠকদেরও। তবে কথা একখানা অবশ্য আছে এখানে। আর সে কারনেই আমার আজকের এই লেখার অবতারনা। সত্যি বলতে কি, মুক্তমনায় খানিকটা গালাগালি খেয়েই আমার মাথায় এসেছিল এই সুক্ষ্ণ বিষয়টা নিয়ে নিবন্ধটা লেখার। কাজেই, on a second thought (দ্বিতীয় মতে), গালাগালি সবসময় বোধহয় খারাপ নয়।
কোর’আনে কি বিধর্মীদের হত্যা করার আয়াত আছে? তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অস্তিত্বের লড়াই, ঘটনাচক্রের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা, আগের ও পরের আয়াতসমুহের ব্যাখ্যা, ইত্যাদি যত যুক্তিই আমরা খাঁড়া করিনা কেন, bottom line বা মোদ্দা কথা হলো, ‘আছে’। কেন আছে তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো মতভেদ এবং লাখো তর্ক-বিতর্ক থাকলেও সেদিকে যাওয়া আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে একজন ধর্মে অবিশ্বাসী কিম্বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জুতায় পা রেখে যদি আমি কোর’আন কে দেখি, তাহলে এককথায় সহজ ও পরিষ্কার উত্তর হলো, ‘আছে’; তা যেভাবেই থাকনা কেন। অনুরূপভাবে, জিউসদের Old Testament বা পুরনো বাইবেলে এবং এবং খ্রীষ্টানদের New Testament বা নতুন বাইবেলেও এমন অনেক ভার্স (আয়াত) আছে যেখানে একইভাবে বিধর্মীদেরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যা করতে বলা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিককালের ধর্মীয় সন্ত্রাসের উত্থানের পটভূমিতে কোর’আন কেন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে কিন্তু সেই একই দোষে দূষ্ট হয়েও পুরনো বা নতুন বাইবেল কেন আসেনি, তা অনেক তর্ক-বিতর্কের ব্যাপার এবং সেটাও আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু নয়। সাথে এটাও উল্লেখ্য যে, আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্থগুলো ছাড়া সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মের (যেমন হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের) ধর্মগ্রন্থগুলোর ‘কন্টেন্ট’ (অন্তর্ভূক্ত বিষয়) সম্পর্কে আমার জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায় হওয়ায় সেগুলোর বিষয়ে স্বভাবতই কিছু উল্লেখ করা এখানে সম্ভব হচ্ছেনা।
ধর্মবিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ হলো ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস করা এবং সে অর্থে প্রকারান্তরে ধর্মগ্রন্থের সব বিষয়কে মৌলিক অবস্থান থেকে মেনে নেয়া। সে অর্থে শুধু ধর্মে বিশ্বাস করার কারনেই (তা জন্মসুত্রেই হোক কিম্বা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েই হোক) একজন জিউস, খ্রীষ্টান কিম্বা মুসলমান ‘বাই ডিফল্ট্’ (by default) বিধর্মীদের হত্যা করার হিংসাত্বক ভার্সগুলোকে মৌলিক অবস্থান থেকে তত্ত্বগতভাবে মেনে নিচ্ছেন। যদিও ‘মেনে নেয়া’ এবং ‘সমর্থন করা’ ব্যাপার দু’টোর মাঝে মৌলিক একটা সুক্ষ্ণ পার্থক্য আছে, কিন্তু তত্ত্বগত দিক দিয়ে কেউ যদি argue (তর্ক) করেন যে, ধর্মে বিশ্বাসীদের সংগা মূলত একটাই যা ‘ধার্মিক’ কেননা by the end of the day (দিনশেষে) মানুষটা কোনো না কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত এবং সেখানে রেডিক্যাল বা মডারেট বলে তত্ত্বগত কোনো বিভাজন নেই, তবে যুক্তি দিয়ে তা খন্ডন করা বেশ কঠিন। কেননা নগন্য কিছু সংখ্যক ধর্মীয় সন্ত্রাসী ধর্মগ্রন্থের হিংসাত্বক ভার্সগুলোর চুড়ান্ত অপপ্রয়োগ করলেও দিনশেষে একজন নিরীহ ধর্মপালনকারীর এবং তেমন একজন সন্ত্রাসীর ধর্মীয় পরিচয় কিন্তু একটাই, তা হলো- সে একজন জিউস, খ্রীষ্টান কিম্বা মুসলমান। এটা একটা প্রচলিত ‘স্কুল অব থট্’ (school of thought) এবং ধর্মে সংশয়বাদী বা অবিশ্বাসীদের বড় একটা অংশের argument বা যুক্তি সাধারনত এটাই। পৃথিবীতে কোনো argument-ই যেহেতু চুড়ান্ত বা absolute নয় এবং যে কেউই যে কোনো argument-এর ব্যাপারে দ্বিমত পোষন করতে পারেন, সে কারনে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী হলো, প্রতিটা ‘স্কুল অব থট্’-এর অস্তিত্বকেই স্বীকার করে নেয়ার মানসিকতা থাকা উচিত এবং দ্বিমত পোষন করলেও সেটাকে একটা ‘স্কুল অব থট্’ হিসেবেই সন্মান করতে শেখা উচিত।