Sunday, 12 March 2017

পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে নির্বাচিত ন্যাপ নেতা খান ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন ২২ মার্চ ১৯৭১। সাক্ষাৎকালে তিনি জানতে চান, তিনি (মুজিব) এখনও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন কি না। জবাবে মুজিব বলেছিলেন, ‌”খান সা’ব, আমি একজন মুসলিম লীগার” (সুত্র: মাহবুবুল আলম, বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, নয়ালোক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)।অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করতে পারেন না। ওই বৈঠকে ওয়ালী খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের ব্যাপারে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন, “তারা হয়ত আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।” শেখ মুজিব হেসে বলেছিলেন “করতে চাইলে করুক, আমি তো স্যুটকেস রেডীই রেখেছি।” এর সমর্থন পাওয়া যায় সিদ্দিক সালিকের লেখা থেকে, যেখানে ২৩ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেল খাদিম রাজার সাথে বৈঠককালে মুজিবের প্রতিনিধি জানান,”ইয়াহিয়ার প্রতি মুজিবের অনুরোধ- তাকে (মুজিবকে) যেনো গ্রেফতার করা হয়। অন্যথায় চরমপন্থীরা স্বাধীনতার ডাক দিতে পারে”।  মুজিব যে আশংকা করেছিলেন, তাহলে ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই কি চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলো?



জোছনার জলরঙ

পঁয়ত্রিশের পর ধনাঢ্য বাঙালি নারীদের একাংশ ভোগেন এক অদ্ভুত অবসাদে। সদ্য-বিগত জমকালো যৌবন আর মাত্রই-হাতছাড়া জ্বলন্ত জৌলুশের নস্টালজিয়ায় তারা ভোগেন হুলস্থুল হীনম্মন্যতায়। মাত্রই বছর পাঁচ-সাতেক আগে একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বা ছিলেন সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা; তারও গোলাভরা ধান ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল, ছিল উঠোনভরা গাছ। মাত্র অর্ধদশকের ব্যবধানে আচমকা প্রাচুর্যের প্রায় সবটা হারিয়ে তিনি নাম লেখান সর্বহারার দলে। কিছুকাল আগেও তার পেছনে ছিল মৌয়ালদের অপেক্ষমাণ তালিকা। তার উন্নাসিক উপেক্ষাকে উপেক্ষা করেও যে মৌয়ালরা তার এতটুকু কৃপার অপেক্ষায় থাকত, পঁয়ত্রিশে তিনি এসে চারিদিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পান— কোথাও কেউ নেই! তিন দেখতে পান সেই সমবয়সী পূজারীরা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে এখন সংসারধর্মে লিপ্ত আছে 'কচি' স্ত্রী নিয়ে, যে স্ত্রীর বয়স ঐ পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটির বয়সের অর্ধেকের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। এই ঈর্ষার ইন্ধনে জ্বলেপুড়ে খাক হন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বা।

একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার সাধারণত দুই বা ততোধিক সন্তান থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে জ্যেষ্ঠ সন্তানটির বয়স হয়ে থাকে পনেরো বা এর বেশি। জ্যেষ্ঠ সন্তানটি কন্যা হলে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব মায়ের সাথে কন্যাটির বয়সের ব্যবধান দাঁড়ায় মাত্র কুড়ি। পরিচিত প্রতিবেশে পঞ্চদশী কন্যাটি যখন পূজারী পুরুষদের প্রাত্যহিক পূজা পায়, তখন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার মনে পড়ে— কুড়ি বছর, মাত্র কুড়ি বছর আগে এমন পুজো আমাকেও করা হতো! চোখের সামনে আত্মজাকে এমন পুজো পেতে দেখে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার সাধ জাগে পুনর্বার সামান্য পুজো পেতে। পুজোপ্রাপ্তির এই পারমাণবিক বাসনা তাকে করে তোলে স্বীয় কন্যার প্রতি ঈর্ষাকাতর!

পঁয়ত্রিশের পর দেহনদীতে অনিবার্যভাবে ভাঙন ধরে, এককালের পাহাড়ি ঊর্ধাঞ্চল পরিণত হয় শাদামাটা সমতল ভূমিতে, প্রসাধনীর প্রচ্ছদে ঢাকা পড়তে থাকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার প্রকৃত প্যারাডক্স। ওদিকে তার ব্যবসাসফল পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বামীটিও বয়সের ভারে উত্থানরহিত কিংবা পরনারীর পরাগায়ণে নিয়োজিত। অর্থ-অলঙ্কারের অঢেল যোগানে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার জীবন হয়ে ওঠে কফি হাউস গানের সুজাতার মতো। কিন্তু পৃথিবীতে দুর্লভতম জিনিশ হচ্ছে সময়। সুজাতারা লাখপতি স্বামী, দামি বাড়ি-গাড়ি পেলেও পান না স্বামীটির 'সময়'। ঝি-চাকরেরা গৃহস্থ সব কাজ করে দিয়ে যাওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার কোনো কাজ থাকে না, স্বামী কর্তৃক সময়বঞ্চিত হয়ে মনে-মনে তিনি হয়ে ওঠেন বেসামাল বিদ্রোহী। স্বামীকে কচি নারীতে আসক্ত দেখে তিনিও হয়ে ওঠেন কচি পুরুষান্বেষী। এমতাবস্থায় কলিং বেলে একবার মৃদু চাপ পড়লেই মুহুর্মুহু খুলে বন্ধ হয়ে যায় তার দরোজা-জানালার সিটকিনি-সমগ্র। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী তরুণকে প্রেমিক হিশেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার অন্যতম কারণ হচ্ছে তরুণটির হাতে থাকে দেওয়ার মতো অঢেল সময়, যা থাকে না স্বামী নামক টাকার মেশিনটির।

পঁয়ত্রিশোর্ধ্বারা প্রশংসার কাঙাল। লক্ষ বাক্যের মহাকাব্য রচনা করেও এককালে যে অপ্সরার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত না, পঁয়ত্রিশ অতিক্রান্ত হবার পর তিনিই চাতকের মতো মুখিয়ে থাকেন এক বাক্যের স্তুতি শোনার জন্যে। কেউ যদি একবার বলে 'বয়সের চেয়ে আপনাকে দশ বছর কম লাগছে' বা 'আপনাকে আপনার মেয়ের বোনের মতো লাগছে' কিংবা কপট করে হলেও কেউ যদি একবার শুধোয়— 'আপনার বয়স বিশ, না বাইশ?' তখনই তার মনের অঙ্গনে সুখের ফাগুন আসে, কাঠির ঘষা ছাড়াই তার দেশলাইয়ে আগুন আসে; এই একটি প্রশ্নের জন্যেই তার ইচ্ছে করে প্রশ্নকর্তাকে সবুজ পাসপোর্ট দিয়ে দিতে!

পঁয়ত্রিশোর্ধ্বাটি কৈশোরে-তারুণ্যে প্রেম করেছেন হয়তো দরিদ্র কারো সাথে; যে তাকে দিনভর কবিতা শুনিয়েছে, রাতভর জোছনা খাইয়েছে। কবিত্ব না থাকলেও তাকে তুষ্ট করতে ছেলেটি হয়তো অনিচ্ছায় কবিতাচর্চা করেছে, ছেলেটি ছিল তার একান্ত বাধ্যগত ব্যক্তিগত কবি। পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতার কবলে পড়ে তার বিয়ে হয় দেড়গুণ বয়সী টেকো কোনো হোঁতকা পেটুকের সাথে; যে পেটুক সওদাগরটি তাকে গা-ভরা সোনা আর পেটভরা সন্তান ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। পেটুকটির সাথে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটি সুখী-সুখী সেলফি প্রচার করলেও তার ভেতরে রয়ে যায় কবিতার কৈ মাছ, জোছনার জলরঙ, বৃষ্টির বীর্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব পতিপ্রবরটি যখন অর্থউৎপাদনের প্রবল প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত; তখন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার ইচ্ছে করে কেউ তাকে নিয়ে কবিতা লিখুক, নিদেনপক্ষে তাকে কেউ কবিতা শোনাক। কিন্তু বছরে একটি করে বাচ্চা দিতে পারলেও পতির সময় হয় না বছরে একটি কবিতা শোনাবার। স্বামীরা বুফে না, সব চাহিদা এক স্বামী দিয়ে পূরণ হবে না; স্বামীরা সেট মেনু, এক স্বামী দিয়ে পূরণ হবে দু-একটি চাহিদা। যে স্বামী কবিতা শোনাবে, স্ত্রীকে তিনি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারবেন না; যে স্বামী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারবেন, তিনি কবিতা শোনাবেন না। এমতাবস্থায় এই কাব্যিক শূন্যস্থান পূরণে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটি নিজেই কবি হয়ে যান, অলঙ্কারবেষ্টিত হয়ে কবিতাপাঠের আসরে যান, সখ্য জমান কোনো উঠতি পুং কবির সাথে। এর পরের অংশ পঠিত বলে গণ্য হোক।

পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব ধনাঢ্য নারীদের জীবনের বৃহত্তম প্রহসনটি হলো ধনাঢ্য পুরুষের সাথে বিয়ে হওয়ায় নারীটিকে কোনো চাকরি করতে হয় না বা করতে দেওয়া হয় না। ফলে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ে অর্জিত অ্যাকাডেমিক সনদগুলো স্টিল আলমারির সবচে সুরক্ষিত জায়গা ছেড়ে বেরোতেই পারে না, অবলীলায় অপচয় ঘটে বিপুল মেধার। না চাকরি, না রন্ধন— কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ থাকে না ধনাঢ্য পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার।

উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ সর্বনারী শিরোধার্য নয়, সব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্যও নয়। নিবন্ধটি আমার অর্ধযুগের যাপিত অন্তর্জালজীবনের অভিজ্ঞতার একটি সরলীকৃত স্থূল রচনা মাত্র। ঠাট্টা করে প্রায়ই বলি— কীটনাশক ও ওষুধপত্র শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন, অস্থির প্রেমিকা ও অসুখী স্ত্রীদেরকে কবিদের নাগালের বাইরে রাখুন। নিষিদ্ধতার গন্ধ পেয়ে কথাটায় কেউ আমোদিত হন, যথাস্থানে যথাআঘাত লাগায় কেউ হন ক্ষিপ্ত। এখন একবাক্যের বক্তব্য দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, ব্যাখ্যা করে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে না দিলে বক্তব্যটি অনেকে বোঝেন না, অনেকে একটু বেশিই বোঝেন।

পুনশ্চ : কবি বলেছেন— একবার ডাক দিয়ে দ্যাখো আমি কতটা কাঙাল, কত হুলস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার!

(courtesy: আখতারুজ্জামান আজাদ)