Tuesday, 14 May 2019

মুরগীর খোপে আমার দিনলিপি। পর্ব-4

অতঃপর মুরগির খোপে আমার জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো। আমি কথিত রোমান্টিক শহর প্যারিসে দিনাতিপাত করিতে লাগিলাম।অবশেষে মুরগির খোপের মধু চন্দ্রিমার দিনগুলো শেষ হইলো।
নির্ধারিত হইলো সপ্তাহে একবার আমাকে রান্না করিতে হইবে। বিলেতে থাকাকালীন ২/৩ জন মানুষের খাবার আমি রান্না করিয়াছি, কিন্তু ৮ জন মানুষের খাবার রান্না করিবার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার নাই। মশলার পরিমাণ বুঝিতে পারিনা , কোনোদিন তেল বেশি, কোনোদিন হলুদ। এ নিয়ে আড়ালে আবডালে কানা-ঘুষা চলিতে লাগিলো। একদিন এক কাগজধারী সবজান্তা শমসের ফোনে বলিতেছিলেন “লন্ডন থেকে আসা সব বাল পাকনা, কাজের কাজ কিছুই জানেনা, শুধু চাপাবাজি”. দরজায় দাঁড়াইয়া আমি শুনিলাম, দুয়ার খুলিতেই একগাল কৃত্রিম হাসি দিয়া কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করিলেন। তারপর রাজ্যের পিনপতন নীরবতা !!!! মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন তাহার কথা আমি শুনিয়াছি কিনা। “বিলেত ফেরত” কিংবা “লন্ডনে ছিলাম“ এ কথা বলিলেই ২৪ হাজার ভোল্টেজের ইলেকট্রিক শক !!! মনে হয় কতিপয় মানুষের পশ্চাৎ দেশে ধুতরার গোটা অথবা চুতরা (বিছুটি) পাতা লাগাইয়া দেয়া হইয়াছে। ফরাসিদের ইংরেজ বিদ্বেষ জানিতাম, বাঙালিদের ইংরেজ বিদ্বেষ প্রথম দেখিলাম !!! যেন বিলেত ফেরত মানুষেরা প্যারিসের বাঙালিদের বাড়া ভাতে ছাই ঢালিয়া দিয়াছে, রিজিকে ভাগ বসাইয়াছে।
ঢাকা শহরের “মালার মা” “মর্জিনার মা“ কিংবা “শাবানা“ বুয়ার রান্না ভক্ষণ আমি অভ্যস্ত। ঢাকা শহরের মেসে বড়জোর ডিমভাজি করিয়াছি। রান্নার হাত আমার ভালো নহে। মজাদার খাবার রান্না করিবার নিমিত্তে আমার চেষ্টার কোনো কমতি রাখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারিনা। প্রায়ই শুনিতাম “হেই মিয়া কিয়া রান্ধে, আন্ডা খাইতাম হারিনা।হারাদিন পরিশ্রম করি আই এগানদি ভাত খন যায়নি ?” মানে তিনি কি রান্না করে, এগুলো দিয়ে ভাত খাওয়া যায়না। এত পরিশ্রমের পর এ তরকারি দিয়ে কি ভাত খাওয়া যায় ? লজ্জায় আমি কুঁকড়ে যাইতাম, কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতামনা। মনে মনে আমি মর্জিনার মা, মালার মা এবং শাবানা বুয়াদের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছিলাম। গুটি কয়েক বুয়া যদি প্যারিসের মুরগির খোপে আমদানি করা যাইতো, তাহা হইলে আমার মতো হাজারো নব্য মুরগির টেনশন কিছুটা লাঘব হইতো।
রন্দভুঁ এবং খাউজানী ********************* ফরাসি দেশে আরেক বিডম্বনার নাম “রন্দভু” বা এপয়েন্টমেন্ট। মানুষকে ইচ্ছে করিয়া হয়রানি করিতে ফরাসিদের জুড়ি মেলা ভার। মাঝে মাঝে ইহা আমার কাছে “কান্ডজ্ঞানহীনদের” দেশ বলিয়া মনে হয়, যুক্তি যেখানে অচল, জবাবদিহিতার বালাই নেই। সরকারি দফতরে সবাই মিলে মিশে চুরি করে, কাজে ফাঁকি দেয়। হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাইবার সুযোগ নাই বলিলেই চলে। অফিসের বড় কর্তা থেকে সিকিউরিটি গার্ড সকলেই চোর, কাম চোর। মনে হয় বিদেশিদের হয়রানি করিবার নিমিত্তে এইসব “চোরদের“ নিয়োগ করা হইয়াছে। “ রন্দভুঁ “ বা “এপয়েন্টমেন্ট ” শব্দটি শুনিলে আমার জ্বর আসিয়া পড়ে। অফিসিয়াল রন্দভুঁতে সময়মতো যাইতে ব্যর্থ হইলে আর রক্ষা নাই, বিনা কারণে ঘুরিতে হইবে দিনের পর দিন। সময়মতো উপস্থিত হইতে ব্যর্থ হইলে ফরাসি দেশের মানুষ ইহাকে ব্যক্তিগত “রাগ-অনুরাগ“ এবং রেশারেশিতে লইয়া যায়। এনিয়ে আমি কয়েকবার বিবাদে লিপ্ত হইয়াছি ফরাসিদের সাথে। ফরাসিদের অনুকরণ করিয়া এখন “বাঙালিদের” সাথেও রন্দভুঁ লইয়া কথা বলিতে হয়। এবিষয়ে অন্য একদিন আলাপ করা যাইবে।
ফরাসি সরকারি দপ্তর গুলোতে কেন আমি “ফরাসি ভাষা জানা” লোক নিয়ে যাইনা এ নিয়ে মুরগির খোপের মানুষদের মারাত্মক খাউজানী উঠিয়াছে।আমার উপর তাহাদের চরম ক্ষোভ, কেনো আমি তাহাদেরকে অনুরোধ করিনা আমার সাথে অনুবাদক হিসেবে সরকারি দপ্তরে যাইতে। তাঁহারা আমাকে বিশেষায়িত করিতে লাগিলো আমি নাকি “বাল পাকনা“ “পন্ডিত“ “বেশি বুঝে“ !!!
ফরাসি দেশে হিজরত করিবার পূর্বে আমি জানিতামনা যে সরকারি অফিস-আদালতে ফরাসি ভাষা জানা ছাড়া কার্য সম্পাদন করা যাইবেনা। ভাষা না জানিলে অনুবাদক লইয়া যাইতে বলা হইয়া থাকে। প্রথমবার অভিবাসন অফিসে যাইবার স্মৃতি মনে পড়িলে আজো আমি আতংকিত হইয়া পড়ি। কাকডাকা ভোরে হিমশীতল শৈত্য প্রবাহে লাইনে দাড়াইয়া কার্য সম্পাদন করিতে গেলাম। ঘন্টা তিনেক লাইনে দাঁড়াইয়া আছি আফ্রিকান এবং কথিত খেজুর(আলজেরিয়ান, তিউনিসিয়ান এবং মরোক্কান) ভাইদের মধ্যখানে। সকাল নয়টার দিকে ভদ্র মহিলা আসিলেন টিকেট বন্টন করিতে। আমার কাছে জানিতে চাহিলেন কি কর্মে আসিয়াছি। আমি ইংরেজিতে বলিলাম, অমুক কর্মে আসিয়াছি। কঠোর ভাষায় আমাকে নির্দেশ দিলেন এই বলে ” ইফ ইউ আর ফ্রান্স, মাস্ট স্পিক ফ্রেঞ্চ”. সাথে সাথে বলিলাম “ আমি এদেশে আসিয়াছি মাত্র ১০ দিন হইয়াছে, ফ্রেঞ্চ পারিনা এবং ফ্রেঞ্চ বলিতে আমি বাধ্য নই।” ভদ্র মহিলা তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন এবং আমার দিকে টোকেন ছুড়িয়া মারিয়া প্রস্থান করিলেন। আমি পুরা “মাননীয় স্পিকার“ হইয়া গেলাম তাঁহার এমন রোমান্টিক আচরণে। এমন বহুবার ঘটিয়াছে আমার সাথে। রোমান্টিক ফরাসি ভাষা না জানার কারণে আমার ফাইল আটকাইয়াছে মাসের পর মাস। বাসায় আসিয়া একদিন বলিলাম এসব ঘটনার ব্যাপারে।মুরগির খোপে বসবাসকারী ”ফ্রান্সের কাগজধারী” এবং “সবজান্তা“ ভাইয়েরা আমাকে উপদেশ করিলেন ইহা বলিয়া যে ” অফিসে যাই সবসময় মাথা নিচু করি কথা বইলবেন, তাইলে ফরাসিরা খুশি হয় !!!! ফরাসি ভাষা শিখেন, ইংরেজির দাম নাই এটা ভুলি যান। “
কিছু কাল আগে আমার বন্ধু বলিলেন, ফরাসি দেশে মানব শরীরের গুপ্ত কেশ ফেলিবার কিংবা ক্ষৌর কর্ম করিবারও অবকাশ নাই। তাহার এই সত্য কথন আমি এক বাক্যে মানিয়া নিলাম। সরকারি অফিসে দৌড়াইয়া আমার পাদুকা জোড়া ক্ষয় হইয়া চরণ যুগল ক্ষয় হওয়া শুরু হইলো। তাহার পরও আমার কর্ম শেষ হইলোনা। সাদা চামড়া ব্যতীত সকলেই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হইয়া থাকিতে হয়। “তথাকথিত কাগজধারী” বাঙালি ভাইদের মতে ইহা মানবাধিকারের স্বর্গরাজ্য। মনে মনে এমন মানবাধিকারকে আমি “বলাৎকার” করিতে লাগিলাম।
মাইকেল মধু চোদন দত্ত এসিটিক খাইছে ফ্রান্সে !!!!! ****************************************** কোনো এক রাতে মুরগির খোপে ডিনার করতে বসিয়াছি। সাথে সব “কাগজধারী” “পন্ডিত“ ব্যক্তিবর্গ। কথা উঠিলো “ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়” লইয়া। কথার প্রসঙ্গে আসিলো সনেট কবি ”মাইকেল মধু সূদন দত্তের” কথা। আমি বলিলাম মধু সূদন দত্ত ফরাসি দেশে আসিয়াছিলেন ভাষা শিখে সাহিত্য রচনা করিবার জন্য। আচমকা একজন বলিয়া উঠিলেন “ আরে মধু চোদন দত্ত তো এসিটিক খাইছে। কেস না পাইয়া আবার দেশে চলে গেছেন “ আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তাই নাকি ?” তিনি জবাবে বলিলেন “হ্যা“ আমি বলিলাম “নতুন কিছু শিখিলাম আপনার কাছ থেকে। ধন্যবাদ “ আহা মুরগির খোপে এমন “শিক্ষিত” “পন্ডিত“ ব্যক্তি !!! আমার জন্য বড় পাওয়া। ..!!!
এস আলম /কেস মারছেন ? **************************** ফরাসি দেশে হিজরত করিবার কিছুকাল পরেই বাঙালি পাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে আমার সাথে সাক্ষাৎ হইলো জনৈক “কাগজধারী“র। প্রথম সাক্ষাতের কথোপকথন নিম্নরূপ : কাগজধারী : ভাই এস আলম মারছেন ? 📷😁 আমি : এস আলম কি ? কাগজধারী: কেস মারছেন ? 📷😁 আমি : কেস কি ? কাগজধারী: আরে ভাই কেস বুঝেননি(বিরক্ত হয়ে) আমি : না বুঝিনি কাগজধারী: এদেশে থাকার জন্য আবেদন আমি : ও আচ্ছা, এসাইলাম কাগজধারী: হা এসাইল আমি : হা আবেদন করেছি। মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষা করছি। কাগজধারী : দেখেন কি হয়। (তাচ্ছিল্যের সুরে)
আমার অনুধাবন: কেস মারা/ এস আলম মারার কথা আমি বুঝিনি বলে তাহার মতে আমি বোকা, বলদ এবং আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। তিনি ফ্রান্সের কাগজধারী, তিনি সব বুঝেন, সবজান্তা।
লাইকা কার্ড নাহলে ধইন্যা পাতা বিক্রি করেন। *************************************** ফরাসি দেশে আসিয়া অফুরন্ত অবসর পাইলাম। খাদ্য ভক্ষণ, নিদ্রা যাওয়া এবং সপ্তাহে কয়েকবার অফিসে আদালতে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কর্ম নাই। বাঙালি পাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে বসিয়া বন্ধুর সাথে আলোচনা করিতেছিলাম বিভিন্ন বিষয় লইয়া। বন্ধু তাহার এক দুঃখের কথা বলিলেন। আমার মতো তাহারও অবসর। এই অফুরন্ত অবসর দেখিয়া জনৈক মেস মেম্বার কহিলেন “ ভাই বসি থাকি কি করবেন “ লাইকা কার্ড (লাইকা মোবাইল কার্ড) নাহলে ধইন্যা পাতা বিক্রি করেন।” এইকথা শুনিয়া সত্যিই আমি চো******না হইয়া গেলাম। কোনো কর্মই পৃথিবীতে ছোট নহে ইহা আমি জানি। কিন্তু এমন অনধিকার চর্চায় আমি অভ্যস্ত নই।
বৌয়ের চিঠি, মায়ের চিঠি আনতে হবে। ********************************* প্রিয় মফিজ কেমন আছো বাবা ? আশা করি ভালো আছো। পর সমাচার এই যে তোমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হত্যা মামলার রায় দিয়েছে।রায়ে তোমার ফাঁসি হয়েছে। তোমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অস্র মামলায় ১২ বছর জেল এবং নারী নির্যাতন মামলায় অভিযোগ পত্র দিয়েছে পুলিশ। বাবা তুমি যে দেশে আছো সে দেশে থাকো। তুমি মানবতার দেশ ফ্রান্সে থাকো। দেশে আসলে আবুল বেপারী এবং তার ভাই কাবিল বেপারী তোমাকে মেরে ফেলবে। আমরা তোমাকে হারাতে চাইনা। আমাদের কথা চিন্তা করোনা। ইতি তোমার দুঃখিনী মা
প্রিয়তম আবুল আশা করি ভালো আছো। আমি ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। তুমি আজ কত দূরে। পর সমাচার, তোমাকে না পেয়ে জয়নাল শিকদারের লোকজন আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি টুনটুনিকে নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে জান বাচাই। তোমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার চার্জশিট হয়েছে। অস্র মামলায় ১৪ বছর জেল হয়েছে তোমার। পুলিশ-র্যাব তোমাকে খুঁজছে ক্রস ফায়ারে দেয়ার জন্য। ওগো প্রাণের স্বামী তুমি দেশে এসোনা। তোমাকে হারালে আমি আর টুনটুনি কাকে নিয়ে বাঁচবো। তুমি বিশ্ব মানবাধিকারের দেশ ফ্রান্সে থাকো। আমাদের জন্য দোয়া করো। ইতি তোমার জরিনা বিবি
প্রথম চিঠিটি মা তার পুত্রকে লিখিয়াছেন এবং দ্বিতীয় চিঠিটি স্ত্রী তাহার স্বামীকে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই চিঠি দিলে নাকি অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দয়া করে। এমন একটি মিথ চালু রহিয়াছে প্যারিসে এবং পুরাতন কাগজধারীরা “অবশ্যই চিঠি দিতে হবে” বলে মনে করে। ইহার কারণে বাঙালিরা ফ্রান্সে বসে নিজে চিঠি লেখিয়া ইমেইলের মাধ্যমে দেশে পাঠাইয়া দেয়, সেই চিঠি আবার পোস্ট অফিসের/ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে লইয়া আসে। অতঃপর চিঠিখানা অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে মায়ের অথবা বৌয়ের চিঠি হিসেবে।
মুরগির খোপে আসিয়া মুরগি হইবার কিছুকাল পরে এই চিঠির শানে নূযুল আমি বুঝিলাম। জনৈক “কাগজধারী” আরেকজনকে কঠিন উপদেশ প্রদান করিলেন মায়ের চিঠি আনিতে। আমাকে একজন অনুরোধ করিলেন একটি মায়ের চিঠি লেখিয়া দিতে। আমি বলিলাম এই ইন্টারনেট, ফোনের যুগে এমন চিঠির কি ভূমিকা কি !!!! তিনি আমাকে বলিলেন, “কাগজধারী চিঠি আনতে বলিয়াছেন, অতএব দিতে হবে “ ”চিঠি লিখে দিতে কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু এ চিঠি অর্থহীন” আমি বললাম। পরে শুনিতে পারিলাম, কাগজধারী ওই লোককে বলিলো “ উনার কথা শুনবেননা, উনি(আমি) কি বা*****ল বুঝে ” অবশেষে বুঝিলাম “ মহান বুঝদার কাগজধারী ” ভাইয়ের জ্ঞানের গভীরতা মাপা সম্ভব নয়। তাঁহার জ্ঞানের কাছে পরাজয় বরণ করিলাম। মনে মনে প্রণাম ঠুকিলাম তাঁহার চরণে। “হে মহা জ্ঞানী বুঝদার ভাই, মানিয়া লইয়াছি আপনার হেডম, মুরগি পালিবেন আমরাও সেটা চাই, বিনিময়ে হবে কি একটু ঠাঁই “
ধুর মিয়া সৌদি আরব রোজার দিনে ইফতার খাবায় ****************************************** মুরগির খোপ সত্যিই বৈচিত্রময়। বহুঘাটের পানি খাইয়া, বহুদেশ ঘুরিয়া মুরগীগণ এ রোমান্টিক শহর প্যারিসে তশরিফ আনিয়াছেন। তাহারও পূর্বে কেউ কেউ আরব দেশে গমন করিয়াছেন। ২/১ জন মালয়েশিয়া গমন করে লাল ঘরে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও জানাইলেন। একদিন কথা উঠিলো মধ্যপ্রাচ্য লইয়া। সৌদি আরবের রাজনীতি, মুসলিম উম্মাহর প্রতি দায়িত্ববোধ লইয়া আলোচনা চলিতেছিল। আমি বলিলাম “সৌদি আরবের রাজতন্ত্র অবসান হওয়া উচিৎ, আমেরিকার গোলামী থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। “ আরেকজন বলিলো “ সৌদি আরব মুসলমানদের সাথে মুনাফেকি করিতেছে, ইসরায়েলের সাথে গোপন সম্পর্ক করে। “ হটাৎ সিনা টান টান করিয়া “সৌদি ফেরত” জয়নাল হাজারীর উম্মত বলিয়া উঠিলো ”ধুর মিয়া, সৌদি আরব রোজার দিনে অন্যদেশের শ্রমিকদের ইফতার খাবায়, বাংলাদেশে এত বড় বড় বিল্ডিং হইছে, কে কইচ্চে জানেন ? সব সৌদি আরব কইচ্চে।” আমি আবারো “মাননীয় স্পিকার”হইয়া গেলাম, “সৌদি রাজতন্ত্র বনাম ইফতার” এবং “সৌদির ইসরায়েল কানেকশন বনাম বাংলাদেশে বড় বড় বিল্ডিং”য়ের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজিতে লাগিলাম।📷😁 ইহার পর হইতে জ্ঞান গর্বে গর্ভবতী ভাইদের সাথে বিতর্ক করিবার সাহস পাইনি। তাহাদের চরণে ভক্তি করিবার মনস্থির করিলাম। (চলবে)
পুনশ্চ : বিনোদিত হউন কিন্তু নিজ দায়িত্বে পড়িবেন। কোনো ঘটনা নিজের উপর টানিয়া লেখককে দায়ী করা যাইবেনা।

Murgir khop 3

ফ্রান্সে যারা বৈধতা পায়নি তারা বৈধদের (তথাকথিত কাগজধারীদের) কাছে নমঃশূদ্র।
ফ্রান্সে অধিকাংশ বাঙালীদের কাছে সফলতা মানেই ফ্রান্সের একটি কাগজ, দুই/চারটা ঘর ভাড়া নিয়ে মুরগী পালা অথবা একটি রেস্টুরেন্টের মালিক হওয়া।
বছর দেড়েক আগের কথা, গার দে নর্ডের
বাঙালি গলিতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম এক বন্ধুর সাথে। কিছুক্ষন পর বন্ধুর এক পূর্ব পরিচিত মাঝ বয়সী লোক আসলো। পরনে থ্রি কোয়ার্টার একটি প্যান্ট, কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ ঝোলানো এবং পায়ে লাল রঙের কেডস পরিহিত লোকটাকে উদ্ভট প্রকৃতির মনে হলো। তারপরও হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করলাম সেই সাথে কুশল বিনিময়।
""কি অবস্থা ভাই কেসের খবর কি ?" লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম "আবেদন দ্বিতীয় ধাপে(CNDA) তে আছে।" সাথে সাথে লোকটির মুখাকৃতি শুয়োরের অবয়ব ধারণ করলো। আমাকে বললো "কি আর করবেন, চেষ্টা করতে তাহেন " যেন কাগজ না পাওয়ায় আমি ধ্বংস হয়ে গেছি, তিনি ব্রাম্মণ আমি নমঃশূদ্র অথবা ফ্রান্সের "কাগজের" কাছে আমি/ আমার যোগ্যতা তুচ্ছ !!!!!
প্রথম পরিচয়ে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে তার "বৈধতার" কিংবা "কাগজের" কথা জিজ্ঞেস করতে পারে, এ কথা আমি কখনো ভাবিনি। "তথাকথিত কাগজ" না পাওয়া যেন প্যারিসে পাপ, ভাগ্য বিডম্বনা এবং জীবনের ব্যর্থতা।
"কাগজ" বলতে সাধারণত আমরা বুঝি লেখা সংরক্ষণের উপকরণ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কাগজে লিখি, পত্রিকা-বই ছাপা হয় কাগজে।
ইউরোপে বসবাসরত বাঙালিদের কাছে "কাগজ" হলো কোনো দেশে থাকার বৈধতা। "রেসিডেন্স পারমিট" বললে অনেকে আশ্চর্য্য হয়, সেটা আবার কি !!! "ভাই কাগজ হইছেনি, কাগজ পেতে কতদিন লাগবে, কাগজ জমা দিবেন কখন, কাগজের মেয়াদ কতদিন ?"
এ রকম প্রশ্ন, আলাপ প্রায়ই শুনি বাঙালিদের কাছে।
একজন আরেকজনকে বিচার করে "কাগজ" দিয়ে। বহু বাঙালিকে বলতে শুনেছি "কাগজ না থাকলে দাম নাই " !!!!! কাগজ থাকাই ব্যক্তিকে মূল্যায়ন/ সম্মান করার অন্যতম শর্ত !!!!
মাস তিনেক আগে, লা চ্যাপেলের বাঙালি অনুবাদ কেন্দ্রের পাশে রেস্টুরেন্টে বসে কফি পান করছি। পাশের টেবিলে এক লোক মনোযোগ সহকারে অনুবাদকৃত পত্রিকার রিপোর্ট দেখছে। কথার প্রসঙ্গে তিনি বললেন সাংবাদিক হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে সাক্ষাৎকারের চিঠি পেয়েছেন তাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকে জানালেন সিলেটে সাংবাদিকতা করে এসেছেন। কোন পত্রিকায় জিজ্ঞেস করলে বললেন "অনলাইন পত্রিকা" !!!! অনেকগুলো রিপোর্ট করেছেন সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে, তাই হুমকি পেয়ে দেশ ত্যাগ। এ বিশিষ্ট অনলাইন সাংবাদিকের শব্দ চয়ন শুনেই বুঝলাম, এ মালের ভিতরে কালির অক্ষর নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই সাংবাদিকতা মানে কি ?
তিনি আমাকে বললেন "তুমি কইয়া দাওনা বা সাংবাদিকতা কিতা " !!!!! কিছুদিন পর ইমিগ্রেশন অফিসে দেখা "অনলাইন সাংবাদিকের" সাথে। ততদিনে তিনি "কাগজধারী" ফ্রান্সের জামাই !!!! আর কি লাগে !!!
প্যারিসের পথে প্রান্তরে এমন বহু বাঙালি "কাগজধারী"কে দেখা যায়। শুনেছি নতুন কাগজধারী হলে নাকি কিছু পরিবর্তন আসে এবং বৈশিষ্ট্য থাকে। যাতে মানুষ বুঝে তিনি কাগজধারী। এ রকম এক কাগজধারীর সাথে একদিন দেখা হলো। চিরাচরিত বাঙালি বেশভুষা "কাগজধারী" লোকটির কাছে দেখলামনা। ফিতা ঝুলানো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে লাল কেডস, গায়ে সবুজ রঙের আঁটসাঁট টি শার্ট এবং কাঁধে ছোট আকৃতির একটি ব্যাগ। মনে মনে বললাম আচ্ছা মানুষটির কোনো সৌন্দর্য জ্ঞান নেই !!!
লন্ডনে আফ্রিকান এবং এশিয়ান অল্প বয়সী ছেলেরা এরকম বেশ-ভুঁশায় চলতে দেখেছি। তাদের অধিকাংশই ড্রাগ বেচাকেনা করে এবং নিজেরা ড্রাগ নেয়। প্যারিসে এসেও দেখলাম আফ্রিকান, আলজেরিয়ান, মরোক্কান এবং তিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূতদের কাছে। কিন্তু বাঙালিরা কেন এ বেশ-ভুশায় চলে ? এলাকার ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বললো "এরকম বাঙালি দেখলেই বুঝবেন তিনি নতুন কাগজধারী" !!!!!
একরকম আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "ভাই আপনার কাছে ঠান্ডা লাগছেনা ?" আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটি বললো, না তার ঠান্ডা লাগছেনা।
লোকটি আরো বললো " জ্যাকেটে শরীর গামায়, মোবাইল আর সিজর(রেসিডেন্স কার্ড) রাখতে অসুবিধা হয়. তাই সিজর ছোট ব্যাগেই রাখি " !!!!!!!! সিজরের কথাটি আমাকে ইচ্ছে করেই বারবার বলছিলেন !!! বুজলাম তিনি কাগজধারী, আমাকে বুঝিয়ে দিলেন তার হেডম !!!!
এমন সস্তা, হাস্যকর বালখিল্যতা আমাকে ব্যাপক বিনোদিত করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটি লেখা লিখতে, যার শিরোনাম হবে "যে মূর্খতার শেষ নেই।"
এসব "তথাকথিত কাগজধারীদের" ভীড়ে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিত্ববান এবং জ্ঞানী মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে প্যারিসে। কয়েকজন তরুণ চমৎকার কাজ করছে বাঙালি কমিউনিটিকে এগিয়ে নিতে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এমন এক জ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসার, যিনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষকে বুর্জোয়া রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন,পড়ার উৎসাহ দেন। আমি বিশ্বাস করি এসব মানুষরাই সমাজকে এগিয়ে নেবেন, ইতিহাসে স্থান করে নেবেন। (চলবে)

পর্ব ৪ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পর্ব ১ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মুরগির খোপ 2

অতঃপর ছারপোকা নামক রাজাকারের কাছে পরাজিত হয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ খ্যান্ত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাজ্যের যত ঘুম আমার চোখে। বেলা সাড়ে এগারোটায় ঘুম ভেঙে গেলো চিৎকার চেঁচামেচিতে। চোখ খুলে দেখলাম মুরগি ব্যবসায়ী দেশে কথা বলছে। চিৎকার-চেঁচামেচিতে প্রকম্পিত আমাদের ছোট্ট মুরগির খোপ। আমার প্রতি তার কোনো
ভ্রূক্ষেপ নেই, সগৌরবে কথা বলে চলেছেন, তিনি ফ্রান্সে অমুক দলের শিক্ষা এবং গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক !!! বাংলাদেশের তমুক মন্ত্রীর সাথে ছবি উঠিয়েছেন ফ্রান্সে। তার রাজনৈতিক খিস্তি খেউর আর শেষ হতেই চায়না। "আঁইতো জনাল আজারির স্টাডিং (জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং )কমিটির সদস্য আছিলাম" মুরগি ব্যবসায়ী ফোনের অপর প্রান্তে থাকা লোকটিকে বললো। আমার আর বুজতে বাকি রইলনা জয়নাল হাজারীর মূর্খ উম্মত প্যারিসেও হাজির। বুজলাম তিনি আকার ইংগিতে আমাকে তার মহান রাজনৈতিক হেডম প্রদর্শন করে চলেছেন। আমার মতো নব্য মুরগি যেন তার মতো "ফ্রান্সের কাগজধারীকে !! " অনেক কিছু মনে করি, সম্মান করি।
মুরগি ডিলারের কথা শেষ হতে না হতেই আরেকজন শুরু করলো কাজিয়া। ঘরের বিবির সাথে কাজিয়া। নব বিবাহিত বধূ বাপের বাড়িতে দুইদিন দিন বেশি থেকেছে বলে শ্বশুর-শাশুড়ির অভিযোগ। অতঃপর এই ঝগড়ার সূত্রপাত। সদ্য বিবাহিত মেয়েটি কিছু বলেনা ফোনের অপর প্রান্তে, আমি ধারণা করি। হয়তো গরীব কিংবা মধ্যবৃত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে "তথাকথিত ফ্রান্সের কাগজধারী" জামাইয়ের কথা শুনে। "তোরে আঁই আর রাইকতান্ন" মানে আমি তোকে আর রাখবোনা। ২ ঘন্টার ঝগড়ায় অন্ততঃপক্ষে ২০ বার বিবি তালাক দিলো লোকটি !!!! যেনতেন তালাক নয় একেবারে বাইন তালাক।
মনে মনে চিন্তা করি, আল্লাহ আমাকে কই আনছো !!! মুরগি ডিলার, রাজনীতিবিদ আর "ফ্রান্সের কাগজধারী"দের ভিড়ে আমি এক এতিম অসহায়। কথা আর শেষ হয়না, খালাতো ভাই, মামাতো ভাই, চুদির ভাই। সব ভাইয়ের সাথে কথা বলে সন্ধ্যা ৬ টায় খেমা দিলো। ততক্ষনে আমি বিরক্তির চরম সীমানায়।
বাসা থেকে বের হব বলে উদ্যত হলাম। " ভাই বেশি ঘুরিয়েননা, পুলিশে দৈৱবো" মুরগি ডিলার বললো। ইচ্ছে করছিলো তার পশ্চাৎ দেশে কষিয়ে একটা লাথি দেই। নিজেকে সংযত করে হাসি মুখে বললাম " আইচ্চা ঠিক আছে "
মাসিক ভাতা ৩৬৯ ইউরো কিংবা ৫৩৫ ইউরো সবাইকে সমান করে ফেলেছে। সত্যিই ফরাসি দেশ সাম্যবাদের দেশ। সব উদ্বাস্তু সমান টাকা পায়।
পড়ালেখা ? মাস্টার্স পাশ ? ধুর মিয়া পড়ালেখা দিয়ে কে কি করতে পেরেছে !!! কাগজ না থাকলে কোনো দাম নাই !!! কাগজ থাকলে বুক ফুলাই বাংলাদেশে যাবেন !!!
মুরগির খোপে নিজের পড়াশোনার কথা বলা আর নিজের পায়ে কুঁড়াল মারা একই কথা। খোপের মাঝে বিদ্যান মুরগির অভাব নেই। কেউ আলু তোলা, মুলা তোলা, জালা তোলা এমনকি মুদি দোকানের উপর পিএইচডি করে এসেছে। একেকজন জ্ঞানেৱ জাহাজ, সর্ব বিষয়ে পন্ডিত। তাইতো আমি নিজেকে বলি স্বশিক্ষিত।
বাহিরে ঘন্টা কয়েক থেকে রাত নয়টায় ফিরলাম মুরগির খোপে। বাসায় ঢুকতেই উৎকট এক গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো, দেখলাম মৎস্য ভাজা চলছে, দরজা-জানালা সব বন্ধ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সারা ঘর, নিশ্বাস নিতে পারিনা। এ যেন জলে কুমিরের ভয়, আর ডাঙায় বাঘের। ঘন্টা দেড়েক পরে ডাক এলো রোমান্টিক প্যারিসের রোমান্টিক ডিনারের। হস্ত যুগল ধৌত করে বসলাম খেতে।
দুই লোকমা মুখে দিতেই শুনি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ !!! আসে পাশে আড় চোখে তাকিয়ে দেখি কিছু দেখা যায় কিনা !!! কিন্তু না কিছু দেখিনা। বাকি তিনজন স্বাভাবিকভাবে ভক্ষণ করে চলছে নীরবে-নিভৃতে। একবার না প্রায় তিনবার শুনলাম এমন বিস্ফোরণের শব্দ। অবশেষে বুজলাম "ইহা পায়ু পথে বায়ু নির্গমনের শব্দ" !!!! বায়ু ত্যাগের শব্দ এত জোরে হতে পারে এবং খাদ্য ভক্ষণরত মানুষ তা শুনবে, এটা আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ঘরটি এত ছোট আর লক্কড় -ঝক্কড় মার্কা, সামান্য কাশি দিলেও বাহিরে শব্দ শোনা যায়।
এরই মাঝে আরেকজন দ্রুত খাবার শেষ করে ঝেড়ে কাশি দিয়ে কফ ফেললো বিনের মধ্যে। ভাত আর নিচের দিকে যায়না। খাওয়া শেষ করার আগেই "ত্যাগী মানুষটা" বীরবিক্রমে বের হলেন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে। তাঁর মুখে ত্যাগের আনন্দ, ত্যাগের মহিমায় তিনি উদ্ভাসিত।
তবুও আমার মোহ ভাঙ্গেনা, আমার বিশ্বাস অটুট থাকে প্যারিসের রোমান্টিকতায়, প্যারিসের সৌন্দর্যে।
রবি ঠাকুরের এক অমর বাণী জপতে জপতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। (চলবে )

মুরগীর খোপ 1

মুরগীর খোপে আমার দিনলিপি-- পর্ব ১

লেখকঃ Azimul Haque Khan

২০১৫ অক্টোবরের মাঝামাঝি আমি ফরাসী দেশে তশরীফ আনি। পেছনে রেখে আসি উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সোনার বাংলাদেশকে। ঝলমলে প্যারিস, লাস্যময়ী প্যারিস, রোমান্টিক প্যারিস কিংবা ভালোবাসার শহর প্যারিস আমার হৃদয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। আইফেল টাওয়ার দেখার কত সাধ, শিল্পের শহর দেখার কত আকুলতা !!!
মোহ ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগলোনা। এলাকার ছোট ভাইয়ের
বদান্যতায় একটি মুরগীর খোপ বরাদ্ধ হলো আমার জন্য। ছোট ভাই আগেই মুরগী ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে একটি খোপ নিশ্চিত করলো আমার মতো নব্য মুরগীর জন্য। এ দূর দেশে বড়ো পাওয়া !!! কয়জনের ভাগ্যে এমন মুরগীর খোপ জুটে ? মধ্য রাতে কর্ম শেষ করে ছোট ভাই আসলো আমাকে নিয়ে যেতে। সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা গার দে নর্ডে, অবাক বিস্ময়ে রোমান্টিক শহরের মানুষ দেখা। বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম মেরি ডে ক্লিশীর উদ্দেশ্যে। আহা কি আনন্দ আজ আকাশে- বাতাসে। নিশ্চয় ইউরোপীয়ান বাড়িঘর অনেক সুন্দর, দামি টাইলস, মার্বেল পাথরের ফ্লোর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
একি !!! আমি ভুল দেখছিনাতো !!! সরু একটি সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম। মট মট আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান। ভেতর থেকে মাঝ বয়সী এক লোক এসে দুয়ারে দাড়ালো। "আইয়েন ভাই ভিত্তে আইয়েন" বলেই ভিতরে যাওয়ার অনুরোধ করলো। মনে মনে বললাম " ওমা আংগো নোয়াখালীর জাপানী কাগু প্যারিসে ও হাজির " . অতঃপর পরিচয় পর্ব। " আংগো বাই হেনি, আঁই ৪ বছর দরি ফ্রান্সে আছি, কাগজ হাইছি " মানে আমার বাড়ী ফেনী, চার বছর যাবৎ ফ্রান্সে আছি, আমি বৈধতা পেয়েছি এ দেশে থাকার জন্য। বুজলাম উনিই বিশিষ্ট মুরগী ব্যবসায়ী, স্বামী-স্ত্রী থাকার এক রুমের এ ঘরকে তিনি মুরগীর খোয়াড় বানিয়েছেন।
মুরগী ব্যবসায়ী এবং তার ছোট ভাই সহ ৭ জন থাকে, আমি সহ ৮ জন হলো। হায় প্যারিস, হায় রোমান্টিক শহর !!! আমার থাকার ব্যবস্থা হলো রান্নাঘরে, একটি চোকি ফেলা হলো। এখানেই আমাকে থাকতে হবে যতদিন এখানে থাকি। এ দূর দেশে মহান মুরগী ব্যবসায়ী আমাকে থাকতে দিয়েছেন এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে ! ঢাকা শহরের মেসে থাকা, মালার মা কিংবা মর্জিনার মা নামক বুয়ার রান্না খেয়ে বেঁচে থাকা আমার জন্য নতুন মুরগীর খোপে থাকা মোটেই কষ্টের নয়। এ জীবনে আমি অভ্যস্ত।
দফারফা হলো ১৫০ ইউরো প্রতি মাসে। কৃষকের মুখে যেমন ফসলের হাসি তেমনি মুরগী ব্যবসায়ীর ঠোঁটে ডিম পাড়া মুরগীর কক কক শব্দ। আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। স্বাদহীন রুই মাছ দিয়ে ভোজন পর্ব শেষ করলাম। মাছ খেলাম নাকি মাটি খেলাম কিছুই বুজতে পারলামনা। এ যেন অভিশপ্ত মাছ, স্বাদ- গন্ধহীন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে চূড়ান্ত বিস্ময়ের সাক্ষাৎ। সোজা হয়ে কমোডে বসার উপায় নাই, ছোট একটা বেসিন সাথে গোছল করার জন্য নেংটির মত একটি পর্দা দিয়ে ঢাকা সরু একটি জায়গা। অবাক বিস্ময়ে অনেক্ষন তাকিয়ে রইলাম। এটা কি ইঁদুর মারার কল নাকি অন্য কিছু ? গোছলের জায়গায় হাত নাড়ানো যায়না !!! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বের হয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম বিশেষ এ ঘরটি এতো ছোট কেন। "সব জায়গায় এমন" ছোট ভাই জবাব দিলো। ক্লান্ত শরীরে ঘুমাতে গেলাম, আহা প্রশান্তির ঘুম।
একি !!! ঘুম ভেঙে গেল রাজাকারদের মুহু মুহু আক্রমণে। পদাতিক বাহিনী আমাকে আক্রমণ করেছে সকল সৈন্য সামন্ত, অস্রশস্র নিয়ে। ছারপোকা আর ছারপোকা, কেউ বলে উরাস !!! ছারপোকার এ সম্রাজ্যে আমি যে এক এতিম অসহায়। রক্তে রঞ্জিত আমার হাত, ছারপোকা নামক রাজাকার মেরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করছি। শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি তো কি হয়েছে, প্যারিসের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি !!! এ আমার বড় পাওয়া।
মুরগী ব্যবসায়ী সহ বাকিরা অঘোরে ঘুমাচ্ছে, শুধু জেগে আছি আমি। যখনি লাইট নিভাই, রাজাকার হামলে পরে আমার উপর। একসময় মুক্তিযুদ্ধে খ্যান্ত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আর কিছু মনে নেই আমার। (চলবে)