Tuesday, 14 May 2019

মুরগীর খোপ 1

মুরগীর খোপে আমার দিনলিপি-- পর্ব ১

লেখকঃ Azimul Haque Khan

২০১৫ অক্টোবরের মাঝামাঝি আমি ফরাসী দেশে তশরীফ আনি। পেছনে রেখে আসি উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সোনার বাংলাদেশকে। ঝলমলে প্যারিস, লাস্যময়ী প্যারিস, রোমান্টিক প্যারিস কিংবা ভালোবাসার শহর প্যারিস আমার হৃদয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। আইফেল টাওয়ার দেখার কত সাধ, শিল্পের শহর দেখার কত আকুলতা !!!
মোহ ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগলোনা। এলাকার ছোট ভাইয়ের
বদান্যতায় একটি মুরগীর খোপ বরাদ্ধ হলো আমার জন্য। ছোট ভাই আগেই মুরগী ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে একটি খোপ নিশ্চিত করলো আমার মতো নব্য মুরগীর জন্য। এ দূর দেশে বড়ো পাওয়া !!! কয়জনের ভাগ্যে এমন মুরগীর খোপ জুটে ? মধ্য রাতে কর্ম শেষ করে ছোট ভাই আসলো আমাকে নিয়ে যেতে। সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা গার দে নর্ডে, অবাক বিস্ময়ে রোমান্টিক শহরের মানুষ দেখা। বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম মেরি ডে ক্লিশীর উদ্দেশ্যে। আহা কি আনন্দ আজ আকাশে- বাতাসে। নিশ্চয় ইউরোপীয়ান বাড়িঘর অনেক সুন্দর, দামি টাইলস, মার্বেল পাথরের ফ্লোর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
একি !!! আমি ভুল দেখছিনাতো !!! সরু একটি সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম। মট মট আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান। ভেতর থেকে মাঝ বয়সী এক লোক এসে দুয়ারে দাড়ালো। "আইয়েন ভাই ভিত্তে আইয়েন" বলেই ভিতরে যাওয়ার অনুরোধ করলো। মনে মনে বললাম " ওমা আংগো নোয়াখালীর জাপানী কাগু প্যারিসে ও হাজির " . অতঃপর পরিচয় পর্ব। " আংগো বাই হেনি, আঁই ৪ বছর দরি ফ্রান্সে আছি, কাগজ হাইছি " মানে আমার বাড়ী ফেনী, চার বছর যাবৎ ফ্রান্সে আছি, আমি বৈধতা পেয়েছি এ দেশে থাকার জন্য। বুজলাম উনিই বিশিষ্ট মুরগী ব্যবসায়ী, স্বামী-স্ত্রী থাকার এক রুমের এ ঘরকে তিনি মুরগীর খোয়াড় বানিয়েছেন।
মুরগী ব্যবসায়ী এবং তার ছোট ভাই সহ ৭ জন থাকে, আমি সহ ৮ জন হলো। হায় প্যারিস, হায় রোমান্টিক শহর !!! আমার থাকার ব্যবস্থা হলো রান্নাঘরে, একটি চোকি ফেলা হলো। এখানেই আমাকে থাকতে হবে যতদিন এখানে থাকি। এ দূর দেশে মহান মুরগী ব্যবসায়ী আমাকে থাকতে দিয়েছেন এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে ! ঢাকা শহরের মেসে থাকা, মালার মা কিংবা মর্জিনার মা নামক বুয়ার রান্না খেয়ে বেঁচে থাকা আমার জন্য নতুন মুরগীর খোপে থাকা মোটেই কষ্টের নয়। এ জীবনে আমি অভ্যস্ত।
দফারফা হলো ১৫০ ইউরো প্রতি মাসে। কৃষকের মুখে যেমন ফসলের হাসি তেমনি মুরগী ব্যবসায়ীর ঠোঁটে ডিম পাড়া মুরগীর কক কক শব্দ। আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। স্বাদহীন রুই মাছ দিয়ে ভোজন পর্ব শেষ করলাম। মাছ খেলাম নাকি মাটি খেলাম কিছুই বুজতে পারলামনা। এ যেন অভিশপ্ত মাছ, স্বাদ- গন্ধহীন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে চূড়ান্ত বিস্ময়ের সাক্ষাৎ। সোজা হয়ে কমোডে বসার উপায় নাই, ছোট একটা বেসিন সাথে গোছল করার জন্য নেংটির মত একটি পর্দা দিয়ে ঢাকা সরু একটি জায়গা। অবাক বিস্ময়ে অনেক্ষন তাকিয়ে রইলাম। এটা কি ইঁদুর মারার কল নাকি অন্য কিছু ? গোছলের জায়গায় হাত নাড়ানো যায়না !!! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বের হয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম বিশেষ এ ঘরটি এতো ছোট কেন। "সব জায়গায় এমন" ছোট ভাই জবাব দিলো। ক্লান্ত শরীরে ঘুমাতে গেলাম, আহা প্রশান্তির ঘুম।
একি !!! ঘুম ভেঙে গেল রাজাকারদের মুহু মুহু আক্রমণে। পদাতিক বাহিনী আমাকে আক্রমণ করেছে সকল সৈন্য সামন্ত, অস্রশস্র নিয়ে। ছারপোকা আর ছারপোকা, কেউ বলে উরাস !!! ছারপোকার এ সম্রাজ্যে আমি যে এক এতিম অসহায়। রক্তে রঞ্জিত আমার হাত, ছারপোকা নামক রাজাকার মেরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করছি। শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি তো কি হয়েছে, প্যারিসের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি !!! এ আমার বড় পাওয়া।
মুরগী ব্যবসায়ী সহ বাকিরা অঘোরে ঘুমাচ্ছে, শুধু জেগে আছি আমি। যখনি লাইট নিভাই, রাজাকার হামলে পরে আমার উপর। একসময় মুক্তিযুদ্ধে খ্যান্ত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আর কিছু মনে নেই আমার। (চলবে)

No comments:

Post a Comment