Tuesday, 14 May 2019

Murgir khop 3

ফ্রান্সে যারা বৈধতা পায়নি তারা বৈধদের (তথাকথিত কাগজধারীদের) কাছে নমঃশূদ্র।
ফ্রান্সে অধিকাংশ বাঙালীদের কাছে সফলতা মানেই ফ্রান্সের একটি কাগজ, দুই/চারটা ঘর ভাড়া নিয়ে মুরগী পালা অথবা একটি রেস্টুরেন্টের মালিক হওয়া।
বছর দেড়েক আগের কথা, গার দে নর্ডের
বাঙালি গলিতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম এক বন্ধুর সাথে। কিছুক্ষন পর বন্ধুর এক পূর্ব পরিচিত মাঝ বয়সী লোক আসলো। পরনে থ্রি কোয়ার্টার একটি প্যান্ট, কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ ঝোলানো এবং পায়ে লাল রঙের কেডস পরিহিত লোকটাকে উদ্ভট প্রকৃতির মনে হলো। তারপরও হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করলাম সেই সাথে কুশল বিনিময়।
""কি অবস্থা ভাই কেসের খবর কি ?" লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম "আবেদন দ্বিতীয় ধাপে(CNDA) তে আছে।" সাথে সাথে লোকটির মুখাকৃতি শুয়োরের অবয়ব ধারণ করলো। আমাকে বললো "কি আর করবেন, চেষ্টা করতে তাহেন " যেন কাগজ না পাওয়ায় আমি ধ্বংস হয়ে গেছি, তিনি ব্রাম্মণ আমি নমঃশূদ্র অথবা ফ্রান্সের "কাগজের" কাছে আমি/ আমার যোগ্যতা তুচ্ছ !!!!!
প্রথম পরিচয়ে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে তার "বৈধতার" কিংবা "কাগজের" কথা জিজ্ঞেস করতে পারে, এ কথা আমি কখনো ভাবিনি। "তথাকথিত কাগজ" না পাওয়া যেন প্যারিসে পাপ, ভাগ্য বিডম্বনা এবং জীবনের ব্যর্থতা।
"কাগজ" বলতে সাধারণত আমরা বুঝি লেখা সংরক্ষণের উপকরণ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কাগজে লিখি, পত্রিকা-বই ছাপা হয় কাগজে।
ইউরোপে বসবাসরত বাঙালিদের কাছে "কাগজ" হলো কোনো দেশে থাকার বৈধতা। "রেসিডেন্স পারমিট" বললে অনেকে আশ্চর্য্য হয়, সেটা আবার কি !!! "ভাই কাগজ হইছেনি, কাগজ পেতে কতদিন লাগবে, কাগজ জমা দিবেন কখন, কাগজের মেয়াদ কতদিন ?"
এ রকম প্রশ্ন, আলাপ প্রায়ই শুনি বাঙালিদের কাছে।
একজন আরেকজনকে বিচার করে "কাগজ" দিয়ে। বহু বাঙালিকে বলতে শুনেছি "কাগজ না থাকলে দাম নাই " !!!!! কাগজ থাকাই ব্যক্তিকে মূল্যায়ন/ সম্মান করার অন্যতম শর্ত !!!!
মাস তিনেক আগে, লা চ্যাপেলের বাঙালি অনুবাদ কেন্দ্রের পাশে রেস্টুরেন্টে বসে কফি পান করছি। পাশের টেবিলে এক লোক মনোযোগ সহকারে অনুবাদকৃত পত্রিকার রিপোর্ট দেখছে। কথার প্রসঙ্গে তিনি বললেন সাংবাদিক হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে সাক্ষাৎকারের চিঠি পেয়েছেন তাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকে জানালেন সিলেটে সাংবাদিকতা করে এসেছেন। কোন পত্রিকায় জিজ্ঞেস করলে বললেন "অনলাইন পত্রিকা" !!!! অনেকগুলো রিপোর্ট করেছেন সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে, তাই হুমকি পেয়ে দেশ ত্যাগ। এ বিশিষ্ট অনলাইন সাংবাদিকের শব্দ চয়ন শুনেই বুঝলাম, এ মালের ভিতরে কালির অক্ষর নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই সাংবাদিকতা মানে কি ?
তিনি আমাকে বললেন "তুমি কইয়া দাওনা বা সাংবাদিকতা কিতা " !!!!! কিছুদিন পর ইমিগ্রেশন অফিসে দেখা "অনলাইন সাংবাদিকের" সাথে। ততদিনে তিনি "কাগজধারী" ফ্রান্সের জামাই !!!! আর কি লাগে !!!
প্যারিসের পথে প্রান্তরে এমন বহু বাঙালি "কাগজধারী"কে দেখা যায়। শুনেছি নতুন কাগজধারী হলে নাকি কিছু পরিবর্তন আসে এবং বৈশিষ্ট্য থাকে। যাতে মানুষ বুঝে তিনি কাগজধারী। এ রকম এক কাগজধারীর সাথে একদিন দেখা হলো। চিরাচরিত বাঙালি বেশভুষা "কাগজধারী" লোকটির কাছে দেখলামনা। ফিতা ঝুলানো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে লাল কেডস, গায়ে সবুজ রঙের আঁটসাঁট টি শার্ট এবং কাঁধে ছোট আকৃতির একটি ব্যাগ। মনে মনে বললাম আচ্ছা মানুষটির কোনো সৌন্দর্য জ্ঞান নেই !!!
লন্ডনে আফ্রিকান এবং এশিয়ান অল্প বয়সী ছেলেরা এরকম বেশ-ভুঁশায় চলতে দেখেছি। তাদের অধিকাংশই ড্রাগ বেচাকেনা করে এবং নিজেরা ড্রাগ নেয়। প্যারিসে এসেও দেখলাম আফ্রিকান, আলজেরিয়ান, মরোক্কান এবং তিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূতদের কাছে। কিন্তু বাঙালিরা কেন এ বেশ-ভুশায় চলে ? এলাকার ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বললো "এরকম বাঙালি দেখলেই বুঝবেন তিনি নতুন কাগজধারী" !!!!!
একরকম আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "ভাই আপনার কাছে ঠান্ডা লাগছেনা ?" আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটি বললো, না তার ঠান্ডা লাগছেনা।
লোকটি আরো বললো " জ্যাকেটে শরীর গামায়, মোবাইল আর সিজর(রেসিডেন্স কার্ড) রাখতে অসুবিধা হয়. তাই সিজর ছোট ব্যাগেই রাখি " !!!!!!!! সিজরের কথাটি আমাকে ইচ্ছে করেই বারবার বলছিলেন !!! বুজলাম তিনি কাগজধারী, আমাকে বুঝিয়ে দিলেন তার হেডম !!!!
এমন সস্তা, হাস্যকর বালখিল্যতা আমাকে ব্যাপক বিনোদিত করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটি লেখা লিখতে, যার শিরোনাম হবে "যে মূর্খতার শেষ নেই।"
এসব "তথাকথিত কাগজধারীদের" ভীড়ে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিত্ববান এবং জ্ঞানী মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে প্যারিসে। কয়েকজন তরুণ চমৎকার কাজ করছে বাঙালি কমিউনিটিকে এগিয়ে নিতে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এমন এক জ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসার, যিনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষকে বুর্জোয়া রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন,পড়ার উৎসাহ দেন। আমি বিশ্বাস করি এসব মানুষরাই সমাজকে এগিয়ে নেবেন, ইতিহাসে স্থান করে নেবেন। (চলবে)

পর্ব ৪ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পর্ব ১ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

No comments:

Post a Comment