Saturday, 5 September 2009

বৌদ্ধ ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, চরমপন্থা কিংবা সন্ত্রাসবাদ

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত নৌ বাহিনীর মেরামত ঘাঁটিতে সামরিক বাহিনীর এক সাবেক সদস্য কর্তৃক আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে (এখানে), যার ফলে ১২ জন ব্যক্তি প্রাণ হারান। এমন ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়। যুদ্ধ ফেরত কিংবা অন্যান্য কারণে ছাটাইয়ের স্বীকার সদস্যগন – যারা সহসা বেসামরিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনা কিংবা নিজেদের অন্যায়ের স্বীকার বলে মনে করে- তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এমন সন্ত্রাস ঘটানোর বহু উদাহরণ আছে। অ্যারন আলেক্সিস নামক এই ব্যক্তিটিও সামরিক বিভাগের নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য- যে মনে করেছে তাকে অন্যায় ভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে। তবে এবারের ঘটনা একটু ভিন্ন ভাবে সংবাদ মাধ্যমে আসছে এই কারণে যে, অ্যারন অ্যালেক্সিস বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত একজন ব্যক্তি। সাধারণে- বিশেষত পাশ্চাত্য সমাজে একটি সাধারণ ধারনা হল বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তিগণ সাধারণত চরমপন্থার (অপরের ক্ষতি করে) আশ্রয় নেননা – যদিও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে অন্য রকম চরমপন্থা তথা অগ্নিসংযোগ করত আত্মাহুতি দিতে প্রায়ই দেখা যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাঝে।
মানব ইতিহাসের অন্যতম ব্যাপক ধর্মীয় চরমপন্থার ডামাডোলে, সমসাময়িককালে যেখানে খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি কিংবা শিখ ধর্মীয় চরমপন্থিদের কর্মকাণ্ডের স্বীকার কোটি নিরপরাধ মানুষ- সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম পালনকারীরা আপাত ভাবে এই অপবাদ থেকে মুক্তই বলা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসা এবং ভালোবাসা যেন একে অপরের পরিপূরক। সিদ্ধার্থ গৌতমের শিক্ষা, যা সম্রাট অশোক কর্তৃক স্বীকৃত এবং গৃহীত হয় এবং তাঁর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাচীন কালেই সমস্ত পৃথিবীতে এই স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু বাস্তব বোধয় এতটা সরল নয়। অন্যান্য যেকোনো ধর্মের মতই বৌদ্ধ ধর্মের গুরু কিংবা কোন কোন অনুসারী ব্যক্তি- রাষ্ট্রের, রাজ্যর কিংবা সমাজের রাজনীতি লালন, কিংবা আরও সঙ্কীর্ণ ধর্ম বিশ্বাস ভিত্তিক উপদলয় ঘৃণা পোষণ হতে মোটেও দূরে থাকতে পারেনি কোন কালেই।
সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কেউ কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে যেমন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন কিংবা প্রতিপক্ষের অত্যধিক ক্ষমতার কারণে কিছু করতে না পেরে আত্মাহুতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন; তেমন আবার কেউ কেউ মেকিয়াভেইলী কিংবা সানজুর তত্ত্বকেও লজ্জা দিয়ে- জনসাধারণকে ধোঁকা প্রদানের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় আবেগকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে।
ইসলামিক / খৃস্টান / ইহুদি / হিন্দু গোঁড়া মৌলবাদী, জঙ্গি/টেররিস্ট ইত্যাদির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কোন ধর্মই চরমপন্থা কিংবা অসহিষ্ণুতা প্রশ্রয় দেয়না। ধর্ম পালনকারী, বিশেষত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য ধর্মকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করে। খুব স্বাভাবিক ভাবে বৌদ্ধ ধর্মও ব্যতিক্রম নয়।
বৌদ্ধ ধর্মের সৃষ্টি দক্ষিণ এশিয়ায় কিন্তু বর্তমানে এর প্রধান কেন্দ্র মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। বৌদ্ধ ধর্মের নামে চরমপন্থার কিছু সংক্ষিপ্ত উদাহরণ –
প্রাচীন এবং মধ্য যুগ:
১. ভারত: বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম অথবা এর চিন্তা ধারা প্রাচীন সনাতন ধর্মের সাম্প্রদায়িক বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন। ভারতে ইসলামিক কিংবা হিন্দু ধর্ম পালনকারী কতক জনসাধারণের অসহিষ্ণুতা সর্বজনবিদিত এখানে যেমন মসজিদ ভেঙেছে হিন্দুরা তেমনি মুসলমানদের দ্বারাও মন্দির ভাঙ্গার ইতিহাস আছে। কিন্তু তারও মুসলিম-হিন্দু সংঘর্ষের আগে ভারতে বৌদ্ধ-হিন্দু ক্লেশ ছিল যা প্রায় ১৬০০ বছর ছিল এবং চরম আকার ধারণ করেছিল ৪০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্য। এমন অনেকবার হয়েছে যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের কাছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিগৃহীত হয়েছে।
২. জাপান: বিংশ শতকের শুরুতে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি সম্পর্কে সবার কম বেশি ধারণা আছে। তখনও জাপানের প্রচুর মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল এবং তৎকালীন সম্রাট হিরোহিতকে বৌদ্ধ , শিন্টো এবং টাও ধর্মের প্রধান মনে করা হতো। এছাড়া জাপানে বৌদ্ধ সশস্ত্র সামুরাই ক্ল্যান ছিল “সোহাই” বলা হত। বৌদ্ধ গুরুদের থেকে মধ্যযুগ হতেই জাপান তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি সমর্থন পেয়ে আসছে ।
৩. চীন: বর্তমান এবং মধ্যযুগের মতই প্রাচীনকাল হতেই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মূল শক্তিকেন্দ্র চীন। অষ্টাদশ শতকের চীনের বড় দুটো বিদ্রোহে এবং বিংশ শতাব্দীতে গৃহযুদ্ধে চীনের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ হানাহানির প্রমাণ পাওয়া যায় এবং মধ্য যুগে তিব্বতের ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে এশিয়ার বিভিন্ন যায়গায় মঙ্গোল আগ্রাসনকে সমর্থন দেবার প্রমাণ আছে।
আধুনিক যুগ:
১. শ্রীলঙ্কা: এখানে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ভিক্ষু / মঙ্কগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টান, হিন্দু এবং মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়মিত বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নিগ্রহের স্বীকার। তামিল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ হিন্দু তামিলদের উপর বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নিগ্রহ। শ্রীলঙ্কান মুসলিমরাও কম নিগ্রহের স্বীকার নয়। কিছুদিন আগেই একটি মুসলিম মাজার ধ্বংস করা হয় এক ভিক্ষুর নেতৃত্বে। অথুরল্ল্যা রাথনা থেরো (Athuraliye Rathana Thero) একজন সর্বজন স্বীকৃত অতি উগ্র
জাতীয়তাবাদী জঙ্গি বৌদ্ধ ভিক্ষু, যিনি আবার শ্রীলঙ্কার আইনসভার সদস্য। ঠিরুকেথিস্রাম, আন্নুরাধাপুরা এবং ডাম্বুলাতে মসজিদ এবং মন্দির ভাঙ্গার নেতৃত্বে ভিক্ষুরা ছিল।
২. বার্মা / মিয়ানমার: বার্মার সংখ্যাগুরু বামার/ মিয়ান্মা জাতিগোষ্ঠীর বৌদ্ধ। বার্মার মিয়ান্মা জাতিগোষ্ঠীর কাছে যেমন অন্যান্য কারেন, শান, কাচিন ইত্যাদি জনগোষ্ঠী নিগৃহীত, তেমনি সামগ্রিক ভাবে বৌদ্ধ চরমপন্থিদের কাছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা এবং কাচিন খ্রিষ্টানরা নিগৃহীত।
মিয়ানমারে বৌদ্ধ চরমপন্থার নেতৃত্বে আছে আসীন উইরাথো (Ashin Wirathu) নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিনি সিস্টেম্যাটিক উপায়ে মিয়ানমারকে মুসলিম মুক্ত করতে বদ্ধ পরিকর। কুখ্যাত ব্রিটিশ গোঁড়া বর্ণবাদ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সংঘটন ইংলিশ ডিফেন্স লিগের কাজের ধারার একনিষ্ঠ প্রশংসাকারী এই ভিক্ষু। তার মতে নিজ ধর্ম এবং জাত রক্ষা করা গণতন্ত্র রক্ষার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তার কথা এবং পাবলিক বক্তব্যর ধরন এক জন মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু কিংবা ইহুদী উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতার থেকে কোন অংশেই ভিন্ন নয়।
অক্টোবর ১৪, ২০১২ সালে মিয়ানমারের মাই বাং মঠে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রায় ১০০ বৌদ্ধ অংশ নেন ইউ উয়াইদাজা প্যাগোডার প্রধান ভিক্ষু জো কেপিন তঙ্গ (Zwe Kapin Taung) এর ঘোষণায় সর্বসম্মতিক্রমে কতগুলো সিদ্ধান্ত হয়:
১. মিয়ানমারের কোন বৌদ্ধ মুসলিমদের কাছে কোন জমি, বাড়ি বিক্রি করতে পারবেনা।
২. বৌদ্ধ মেয়েদের সাথে মুসলিম মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবেনা।
৩. বৌদ্ধদের কেবল বৌদ্ধ মালিকানাধীন দোকান হতে সামগ্রী ক্রয় করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
৪.বৌদ্ধদের জমি, বাড়ি বিক্রি কিংবা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিমদের সাহায্য কিংবা নিজেদের নাম ব্যবহার করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হচ্ছে।
এখানে আরও ঘোষণা করা হয় যারা উক্ত আদেশ মানবেন তারা শাস্তি প্রাপ্য।
এটা সমগ্র বার্মার ক্ষুদ্র চিত্র। মিয়ানমারের প্রধান জনগোষ্ঠী বামাররা/মিয়াম্মারা মুসলিমদের নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত করেছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব করেছেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের তৃতীয় কোন দেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্থানান্তরিত করা হউক। এটা অবশ্যই কেবল শাসক গোষ্ঠীর আচরণ নয়, মিয়ানমারের বৃহত্তর বামার জনগোষ্ঠীর “ভক্স পপুলাই” যার ইন্ধনে আছে কতক বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
আফগানিস্তানের তালেবান দের সাথে বার্মার এই বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীর কোন পার্থক্য নেই। আফগানিস্তানে তারআ কট্টর ইসলামিক দেশ গঠন করতে চায় আর মিয়ানমার / বার্মায় এরা স্বপ্নের গোঁড়া বৌদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করতে চায়।
৩. থাইল্যান্ড: গত শতাব্দীর মধ্যভাগে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ কম্যুনিস্ট দমনে জড়িয়ে পরে- এর জন্য সামরিক জান্তাদের সাথে আঁতাত করতেও তারা পিছুপা হন না। সামরিক জান্তার মদদে যে আধাসামরিক বাহিনী থামাথা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা (১০০ রো বেশি নিহত এবং শতাধিক আহত) চালিয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল ফ্র্যা কিতিউত্থা (Phra Kittiwuttho) নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু যার যিনি মনে করতেন কম্যুনিস্টদের হত্যা করা পাপ নয়।
থাইল্যান্ডের দক্ষিনাঞ্চলে সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করতে নিয়মিত বাহিনীর সাথে সাথে রাজকীয় কমিশনড সহ সশস্ত্র ভিক্ষু নিয়োগ দিয়েছে। ধর্ম এবং রাষ্ট্র যেখানে একে আপরের পরিপূরক। সশস্ত্র বুদ্ধ ভিক্ষুরা বিভিন্ন মানুষ প্যাগোডায় এনে প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতন করছে এবং হত্যা করছে – যেমনটি সাধারণত কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনরত এলাকায় নিয়মিত সরকারি আধাসামরিক বাহিনীর করতে দেখা যায়।
৪. কম্বোডিয়া: কম্বোডিয়ায় খেমারুজরা বৌদ্ধ ধর্মের নামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পলপট, যে যৌবনে বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিল নিজেকে দেশের বৌদ্ধদের প্রধান মনে করত। চাম জাতিসত্তার মুসলিমরা গণ হত্যার স্বীকার হয় কম্বোডিয়ায়।
সমাজের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তারা প্রতিটি ধর্মকেই উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে – যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। এটাকে মানব কল্যাণ এবং শান্তির দূত হিসেবে ব্যবহার করা যায়; আবার ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়, যা হয়ত উক্ত ধর্মের মৌলিক ভিত্তির সাথেও সাংঘর্ষিক । আসলে ধর্মকে দোষ দিয়ে লাভ নেই- ধর্মকে যারা এভাবে ব্যবহার করে তাদেরই কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবে।
এই পোষ্টের উদ্দেশ্য বৌদ্ধ ধর্ম পালনকারী, বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের সমালোচনা করা নয় নয়। শুধুই সামান্য আলোচনার চেষ্টা – ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু কিংবা ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের মধ্য যেমন মানবতা বিরোধী কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তি আছে তেমন বৌদ্ধ ধর্ম পালনকারীদের মধ্যও এমন ব্যক্তি আছে। আদতে ধর্মের কথা বলে সাধারণ মানুষের পরাজাগতিক ধর্মীয় আবেগ কে হীন ভাবে ব্যবহার করে খুবই জাগতিক অনৈতিক কাজ কিংবা হীন-স্বার্থ সম্পাদনের চেষ্টা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরেই।
বইঃ
১. Buddhist Warfare by Michael Jerryson and Mark Juergensmeyer
২. Buddhist Fury by Michael K. Jerryson
৩.Zen at War by Brian Daizen Victoria
৪. The Buddha and the Terrorist, by Satish Kumar
৫.Books & Research Papers by Mahinda Deegalle, Bath Spa University, Humanities, Faculty Member
ব্লগ এবং অপিনিয়নঃ
২. The Face of Buddhist Terror, by Hannah Beech, time.com
৪. Buddhist Terrorism: No Longer A Myth, By Dr. Habib Siddiqui, eurasiareview.com
৫. Who Holds Real Power in Myanmar? by Aung Aung Oo, Salem-News.com
৬. Of A Sustained Buddhist Extremism in Sri Lanka, by Raashid Riza, the-platform.org.uk
৭. Monks With Guns: Discovering Buddhist Violence, by Michael Jerryson, religiondispatches.org
৮. buddhism-has-extremists-too, by Jen, freethoughtblogs.com
নিয়মিত সংবাদঃ
৭. Muslim shrine destroyed in Anuradhapura, transcurrents.com
উইকিপিডিয়াঃ

আদালত অবমাননা বনাম আদালত সমালোচনা !!!!!

রাজতন্ত্রে রাজা-রানী কিংবা রাজপরিবারের প্রাথমিক সদস্যদের সমালোচনা করা অপরাধ, রীতিমত ফৌজদারি অপরাধ, কোন কোন রাষ্ট্রে এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আইনি পরিভাষায় lese majesty নামে পরিচিত। সমসাময়িককালে অনেক দেশে আইনটি হালকা প্রয়োগ হলেও কোন কোন রাজতন্ত্রে, বিশেষত এশিয়ার অনেক দেশে খুবই গুরুত্বের সাথে প্রয়োগ করা হয়। রাজতন্ত্রের আরও অনেকগুলো নর্মের মধ্য অন্যতম হল – রাজা-রানীকে “না” শুনানো যাবেনা এবং তাদের দিকে উল্টো ঘুরে প্রস্থান করা যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি

… রাজতন্ত্রে বসবাসকারী জনগণ একাধারে ঐ রাজ্যর নাগরিক (citizen of the country) এবং রাজা/রানীর তথা একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রজা (subject of the crown)। ব্রিটেন কিংবা নেদারল্যান্ডের মত প্রগতিশীল দেশের নাগরিক যেখানে নাগরিক অধিকার সর্বোচ্চ, তবুও সিম্বলিক্যালি সেখানকার নাগরিকগণ কারও সাবজেক্ট। সাধারণতন্ত্রের/প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে এই দিক থেকে আমরা আসলেই অনেক ভাগ্যবান।
রাজতন্ত্রে উচ্চ আদালত এবং নিম্ন আদালতের বিচারকগণ হলেন রাজা/ রানীর প্রতিনিধি যারা রাজন্যর হয়ে বিচার কাজ সম্পন্ন করেন। শুধু বিচারক নন- রাজা দ্বারা কমিশনড এবং গ্যাজেটেড প্রাপ্ত সকল ব্যক্তিই রাজা/রানীর প্রতিনিধি। রাজতন্ত্রে তিনটি সমাজ বিদ্যমান – রাজ-পরিবার, অভিজাত এবং সাধারণ। আধুনিক গ্রেট ব্রিটেনেও এই পার্থক্য খুবই ভালোভাবে সমাজের বিভিন্ন যায়গায় বজায় রাখা হয়। ব্রিটেনের দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা হলেও একটা ব্যাপার খুবই লক্ষণীয় – ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ জয়েন্ট সেশন হয়না (কেবল রাজ অভিষেক ব্যতীত) – এবং ওটাতেও হাস্যকর ভাবে অভিজাত এবং সাধারণ এই দুয়ে পার্থক্য করা হয় – উপরন্তু রাজা-রানী কখনও হাউজ অফ কমন্স এ প্রবেশ করেননা। কেননা সাধারণদিগের সমাবেশ প্রবেশ করা রাজন্যর শানের অপমান।
সাধারণতন্ত্রে বিচার বিভাগের কনসেপ্ট ভিন্ন – সাধারণতন্ত্রে বিচারপতিরা – জনগণের কর্মচারী মাত্র, যারা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োজিত এবং প্রজাতন্ত্রের প্রচলিত আইন, যা জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা পার্লামেন্টে গৃহীত হয় তার ব্যাখ্যা এবং তার আলোকে জনগণের বিভিন্ন অভিযোগ খণ্ডন করেন।
রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ
আমাদের দেশের বিভিন্ন পাবলিক ইন্সটিটিউশন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত। যেহেতু ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তি কোন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়নি তাই পুরো সিস্টেম হঠাৎ বদলায়নি। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত (ভারতের সংবিধানের ২৬ তম সংশোধনীর আগে) ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবার (কাগজে কলমে মূলত ব্রিটিশ সেক্সকোবার্গ গোথা রাজ পরিবারের সাবেক সামন্ত) বিভিন্ন সরকারী সুবিধা ভোগ করত। বেসামরিক এবং সামরিক সরকারী কর্মচারী (বিশেষত যারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কমিশনড প্রাপ্ত গেজেটেড) মাঝেও অভিজাত ভাবটা বহুদিন পর্যন্ত ছিল। এখন অনেক কমে গিয়েছে।
একটি প্রজাতন্ত্রে সবাই জনগণের কর্মচারী – প্রজাতন্ত্রে শাসন বিভাগের ভূমিকা ব্যবস্থাপকের এবং সমন্বয়কারীর, আইনসভার তদারক ব্যবস্থাপনা প্রণয়নকারীর এবং বিচার বিভাগের ভূমিকা মধ্যস্থতাকারী ব্যবস্থাপনা বিধি ব্যাখ্যাদানকারীর – সবাই রাষ্ট্রের তথা জনগণের কর্মচারী। এই তিনটি স্তম্ভের আলোচনা-সমালোচনা করা রাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক অধিকার।
সমালোচনা করার অধিকার মানেই যা ইচ্ছা তা বলা নয় – কেননা এতে অন্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার সবার থাকতে হবে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে কেউই নয়।
#রাষ্ট্রের কর্মচারীদের সমালোচনা দু ভাবে হতে পারে –
১. ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা সামাজিক প্রেক্ষাপটে ।
২. দায়িত্বরত অবস্থায় কৃত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে ।
#এ দুটি ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কারণে সমালোচনা করার অধিকার জনগণ দুই ভাবে সংরক্ষণ করে –
১ ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে সমালোচনার অধিকার।
২. ভোটার এবং করদাতা হিসেবে সমালোচনার অধিকার।
সমালোচনা দুভাবে করা যেতে পারে – 
১. বাক্যর মাধ্যমে
২. কাজের মাধ্যমে
সমালোচনা এবং অবমাননা দুটি ভিন্ন ব্যাপার। সমালোচনা করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার এবং অবমাননা করা একটি অপরাধ। যেকোনো নাগরিককে অপর কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী অবমাননা করলে এর প্রতিকার চাওয়ার অবিকার সবার আছে।
গ্রামের একজন চৌকিদারের সমালোচনা করার অধিকারের মত রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করার অধিকারও নাগরিকের আছে। এমন ভাবেই সংসদগণ প্রতিনিধি, সরকারী চাকুরে সবার সমালোচনা করার অধিকার জনগণ রাখে। তেমনি বিচার বিভাগ এবং বিচারকদের কাজেরও সমালোচনা করার অধিকার সবাই রাখে। সমাজের যেকোনো ব্যক্তির সমালোচনা করার অধিকারও অন্যরা সংরক্ষণ করে।
অন্যদিকে, লাইসেন্সধারী – আইনমান্যকারী দেহব্যবসায়ীরও অবমাননা করার অধিকার রাষ্ট্রের অন্য কারো নেই; যেমন কারো নেই প্রেসিডেন্ট, আইনসভা কিংবা বিচার বিভাগের অবমাননা করার এবং এই সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের। এমনকি যেকোনো আইন পালনকারী কোন ব্যক্তির অন্য আইন পালনকারী ব্যক্তিকে অবমাননা করার অধিকার নেই। এমনকি সংবাদপত্রেরও এই অধিকার নেই – কেননা অবমাননা করা একটি অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড। আইন মান্য-কারী যেকোনো নাগরিককে অবমাননা হতে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
কিছু অপ্রিয় সত্য ব্যাপার
আমাদের উপমহাদেশে বিচারকগণ সমাজে অত্যন্ত মর্যাদায় অধিস্ট আছেন। বলা হয়ে থাকে মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় কোন কোন বিচারপতিরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারের অবৈধ অন্যায় কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এসেছেন। ব্রিটিশ আমল অনেক দূরের। আমরা পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেই দেখেছি কতিপয় বিচারপতির সামরিক জান্তার লেজুড়বৃত্তি। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনির এবং শেখ আনোয়ারুল হক বিচার বিভাগীয় মেকিয়াভিলিয়াজম এর জন্মদাতা। সম্প্রতি মিশরেও দেখা গিয়েছে ওখানকার বিচারপতিরা কিভাবে গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামরিক সরকারে-এবং শাসনের লেজুড়বৃত্তি করতে। আমেরিকার দাসপ্রথা তার স্বাধীনতারও ৮০ বছরেরও বেশি সময় বজায় ছিল; এর অন্যতম কারণ তৎকালীন কতক বিচারপতির অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তা ভাবনা – বিচারপতি রজার বি ট্যানি মনে করতেন কালো মানুষের কোন অধিকার নেই মৌলিক অধিকারের।
বাংলাদেশের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে-
বিচারপতি নুরুল ইসলাম যিনি যুদ্ধের সময় প্রকাশ্য পাকিস্তানী সরকারকে সহায়তা দিয়ে গিয়েছেন তথা পাকিস্তানের গণহত্যার অন্যতম সহযোগী; পরবর্তীতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। যদিও ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর তিনি সামরিক জান্তা কর্তৃক পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। বিচারপতি সাত্তার মুক্তিযুদ্ধের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে আঁতাত করত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আইনসভা তথা জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত আওয়ামীলীগের নির্বাচিত সদস্যর আসন শূন্য ঘোষণা করে রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্বাচিত ঘোষণা করেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অনূগত থেকে তাদের নানা অপকর্মে সহায়তা দিয়ে গিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রেখেছিলেন স্বৈরশাসনের পথ সুগম করার জন্য। আবার অন্য দিকে, বিচারপতি সায়েম মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখলেও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অন্যান্য অনেকের মত রাজনৈতিক অঙ্গনে খুবই প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রেখেছিলেন – তিনিও স্বৈরশাসকের সাহায্য কাজ করেছিলেন। বিচারপতি এম মাসুদ নির্বাচন কমিশনার থাকার সময় আক্ষরিক ভাবেই স্বৈরাচারী এরশাদের রাজনৈতিক ব্যাডবয় হিসেবে কাজ করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটি তামাশায় পরিণত করেছিলেন।
বিচারবিভাগ এবং সমাজ
আমাদের দেশের বিচারপতিদের যেন সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন। তারা কোথাও যেতে পারেননা কিংবা গেলেও সংবাদপত্রে চলে আসে। যেন বিচারপতিরা সমাজের বিচ্ছিন্ন কেউ!
একটা বিখ্যাত উক্তি আছে – পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারেনা। আমাদের এই “নিরপেক্ষ” নামক অস্বচ্ছ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নাহলে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করার জন্য ভিন্ন দেশ হতে জনগণ ভাড়া করতে হবে। অন্যথায় এই “নিরপেক্ষ” নামক ধোয়া থেকে বের হয়ে এসে আমাদের জোড় দিতে হবে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালনের প্রতি। কোথাও ইন্সপেকশনে গেলে কিংবা সাইট হ্যান্ডিংএ গেলে আপ্যায়ন করা স্বাভাবিক – কিংবা কাজের ক্ষেত্রে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়া স্বাভাবিক। এটা ঘুষ নয়- সামাজিক ভদ্রতা। এর মানে এই নয় যে কেউ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করবেননা। এতেই যদি দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয় – তাহলে ব্যাপারটা এমন নয় কি যে দায়িত্ব পালনে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়।
আমাদের প্রধান সমস্যা হল আমরা যৌক্তিক থেকে সরে সবসময় অতিমাত্রার আশ্রয় নেই। হয় দেবতা নাহলে শয়তান – আমরা ভুলে যাই এই দুইয়ের মাঝে মানুষ। যারা কোর্টের বিচারপতি হন তারাও এই মাঝের অংশে পরেন। তারাও অন্যান্য সব কিশোর – যুবকদের মত বয়স পার করে এসেছেন। তারা কোনভাবেই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। একজন জজকে রাষ্ট্র যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে – খুবই মানবিক ভাবেই তারা ক্ষমতার কারণে অনেক সময় ভুল কিংবা ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত কিংবা কাজ করতে পারেন – যা একমাত্র গঠনমূলক সরাসরি সমালোচনার মাধ্যমে তাদের এ ব্যাপারটি সম্পর্কে সর্বদা সজাগ রাখতে হবে। যদিও বিচারকগণ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গের কর্মচারী হতে অপেক্ষাকৃত নিজ দায়িত্ব এবং অবস্থান সম্পর্কে বেশি সচেতনতা রাখেন – ভুল হতেই পারে।
কতিপয় ঘটনাবালি –
কতগুলো খুব দুঃখজনক ঘটনা আছে – কিছুদিন আগে যমুনা ব্রিজে টোল না দিয়ে এক বিচারপতি ব্রিজে উঠে পড়েন আবার বেআইনি ভাবে ব্রিজের মাঝে গাড়ি থামিয়ে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এর পর টোল চায়তে গেলে বিচারপতি টোল দেওয়া দূরের কথা- পুলিশকে দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করান। দোষ ছিল ব্যক্তিটি নাকি বেয়াদবি করেছেন। একটি প্রজাতন্ত্রে এর থেকে বড় তামাশা আর কি হতে পারে। সে যদি আসলেই বেয়াদব করে তাহলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করা জেত। তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হয়রানি করা হয়। কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না পেয়ে। তাকে যে হয়রানি করল তার কিছুই হলনা।
বিভিন্ন দেশে উচ্চ এবং নিম্ন আদালতের বিচারকগণ এবং তাদের পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন কারনে ক্রাইমেও জড়িত থেকেছেন – শাস্তিও হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মূহুর্তে মনে পড়ছে – কিছুদিন আগে নিম্ন আদালতের এক বিচারক ফেন্সিডিল সহ ধরা পরেছিলেন – এখন জেলে। বেশ কয়েক বছর আগে এক বিচারপতির পুত্র একটি বেসরকারি বহুজাতিক কোম্পানির প্রকৌশলীকে এসিড মেরেছিল – জামিন অযোগ্য অপরাধ হলেও পুলিশ ছেড়ে দেয়। এই কেসের পরে কি হয়েছিল এখন জানিনা – সংবাদ পত্রে এটা নিয়ে আর তেমন রিপোর্ট হয়নি। আরেকটি হল – বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফায়েজির এলএলবি আইন ডিগ্রীর সার্টিফিকেট জাল করে উচ্চ আদালতে নিয়োগ পাওয়া এবং ঘটনা ফাঁসের পর পদত্যাগ করা। ইন্টারনেটে খুব সহজেই পাওয়া যাবে অন্যান্য দেশের অবস্থা।
প্রায় এমন হয় – কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে রাখা হয় শাস্তি সরূপ অভিযোগ প্রমানের আগেই। একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই রাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা খুবই দুঃখজনক। আমাদের বিভিন্ন আইনের সংশোধনের সাথে সাথে আদালতের এসব ঔপনিবেশিক কালচার দূর করতে হবে।
বিচার বিভাগের চেক এন্ড ব্যালেন্স –
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক যে কয়েকটি আইনি ব্যবস্থা আছে তার একটি হল তথাকথিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এই ব্যবস্থাটি – মূলত এটা পাকিস্তান আমলে কিছুদিনের জন্য করা হয়েছিল – যুক্তি ছিল সংসদ সদস্যরা পর্যাপ্ত “অভিজ্ঞ” নয় বিচার বিভাগকে “চেক” করার। এর পর এটাকে তুলে দেওয়া হয় যা স্বৈরশাসকগণ আবার নিয়ে আসেন; যেন এক্সিকিউটিভ এবং জুডিসিয়ারির সমঝোতায় (যেমন ডক্ট্রিন অফ নেসেসিটির মত রুল জারিতে) – আইন বিভাগকে পাশ কাটিয়ে কাজ করতে সুবিধা হয়। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমন ব্যবস্থা এছে – যে কয়টিতে আছে সবগুলোই স্বৈরশাসনের জন্য কুখ্যাত যেমন পাকিস্তান কিংবা মিশর। আমাদের দেশে বিচারপতিরা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ নন – তারা দায়িত্ব নেবার আগে সংসদ হতে কোন হিয়ারিং এর দরকার হয়না আবার গুরুতর অসদাচরণের জন্যও তাদের সংসদের কাছে কোন দায় নেই – নিজেরাই নিজেদের বিচার করেন। এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের ট্র্যাডিশনাল চেক এন্ড ব্যালেন্স এর উপযুক্ত নয়। এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ দিয়ে বিচারকদের অসদাচরণের জন্য অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যাস্ত করা উচিত।
আদালত অবমানানা আইন –
আদালত অবমাননা বলতে একেবারে সোজা ভাষায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি আবশ্যক কর্তৃপক্ষ আদালতের তথা বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব স্বীকার না করা কিংবা সাধারণ নির্দেশ -আদেশ ইত্যাদি অমান্য করা বোঝায়। এর সাথে যোগ হয় রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ বিচার বিভাগ তথা আদালতকে অপমান, তাচ্ছল্য কিংবা অবজ্ঞা করা।
কিছুদিন আগে আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ (যা মূলত আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ – ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকারের ১৯২৬ সালে করা আইনের সংস্কার) অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কিছু ধারার অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন; যেমন আইনে স্পষ্টত অন্যায় ভাবে দুটি গ্রুপকে (আমলা এবং সাংবাদিক) সম্পূর্ণ অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যেখানে আমজনতার তথা প্রাইভেট সিটিজেন যারা রাষ্ট্রে “আপামর জনতা” তাদের ব্যাপারে স্পষ্টত কিছু বলা হয়নি। বিচার বিভাগকে সমালোচনা করতে যেয়ে শাসন বিভাগকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা টিরানির অপ্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। গণতন্ত্র অধিকার নামে উক্ত আইনে অত্যন্ত নির্লজ্জ ভাবে সরকার সরকারী কর্মকর্তাদের পাইকারি অব্যাহতি দিতে চেয়েছে।
আবার এটাও ঠিক, এই মামলা দিয়ে অবৈধ কাজ চালিয়ে যাবার একটি প্রচেষ্টা সবার মাঝেই দেখা যায় – সরকারী এবং বেসরকারি দুটো ক্ষেত্রেই। আমলাদের দাবী অনুযায়ী তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আসলে আদালতের সমালোচনা (বাক্য দ্বারা) নয় – কোর্ট অর্ডারের জন্য প্রশাসনিক কাজের সমস্যা। তথা, তাদের কাজের মাধ্যমে সমালোচনা সমসাময়িক আইনে কাজের মাধ্যমে অবমাননায় রূপ নেয়। প্রচলিত আইনে কোর্টের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু “করলেই” অবমাননা – এই সুযোগে কেউ স্থগিত আদেশ নিয়ে আসলে গোটা ব্যবস্থাটি জগদ্দল পাথরের মত স্থবির হয়ে যায়। সামান্য বদলী এমনকি অবৈধ কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তিও কোর্ট হতে স্থগিত আদেশ নিয়ে আসে – গোটা সিস্টেমই এর কারণে স্থবির হয়ে যায়। কিছুদিন আগে এসএ পরিবহণ নামক একটি বেসরকারি কুরিয়ার কোম্পানি কোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে – ঢাকা শহরে যেন তাদের বড় পরিবহণ ট্রাক ঢুকতে পুলিশ বাধা না দেয় সে জন্য – পুলিশের কিছুই করার থাকেনা এতে; অন্যদিকে এই কোম্পানির অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিযোগী তাদের বড় গাড়ী ঢাকা শহরে ঢুকাতে পারতোনা পুলিশের বাধার কারণে কেননা তাদের কোর্টের স্থগিতাদেশ ছিলনা যার ফলে, ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে অনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অবস্থা স্পষ্টতই আইনের শাসনের খেলাপ। যদিও নির্বাহী বিভাগের কিছুই করার নেই – কোর্টের স্থগিতাদেশ না মানলে আদালত অবমাননা হবে।
সংবাদ মাধ্যমের বিষয়টি বাক্যর মাধ্যমে সমালোচনা মাঝে মাঝে বাক্যর মাধ্যমে অবমাননায় রূপ নেয়। সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকদের দের ব্যাপারটা সামগ্রিক ভাবে জটিল – প্রথমত সংবাদসংস্থা অলিখিত ভাবে রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ হলেও এটি একটি ব্যবসা। সব ব্যবসার মতই এতে বিনিয়োগ থাকে – যা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেন। অনেক সময় সাংবাদিক তাদের প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীর তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে প্রতিটি ব্যবসায়ী কোম্পানি নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা সামান্য ভালো হলেই সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করে – প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক দুই ক্ষেত্রেই। বেশিরভাগ সময় এর মূল উদ্দেশ্য সংবাদ মাধ্যম দিয়ে ব্যবসা নয় – এর মাধ্যমে তার অন্যান্য মূল ব্যবসা এবং নিজের সামাজিক অবস্থান শক্ত করা।
সুতরাং, গণহারে এক লাইনে দায়মুক্তই দিলে এটার যথেচ্ছ ব্যবহার হবে। আগে ঠিক করতে হবে কোন কোন এই অবমাননার আইন প্রযোজ্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় – যা আইনে ব্যাখ্যা সহ থাকতে হবে।
লক্ষণীয়, নৃপতি অবমাননা / রাজা-রানীর অপমান (lese majesty ) এবং আদালত অবমাননা আইনের (Contempt of Court) এর “কাছাকাছি” আইনসভা অবমাননা (Contempt of Parliament) ও কোথাও কোথাও আছে। মানহানি / অপবাদ আইন (Defamation) প্রায় সব দেশে আছে। আরেকটি হল ধর্ম অবমাননা / ধর্ম নিন্দা / ঈশ্বর অবমাননা আইন (Blasphemy) – এটা অনেক দেশে থাকলেও কোথাও প্রয়োগ হয় কোথাও হয়না – সবচাইতে বিতর্কিত। বিধি অবমাননা (Contempt of Statute) নামক একটি ধোঁয়াশা আইনও আছে কোথাও কোথাও।
আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি যেন এক না হয়ে যায়। ফরাসী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের চেতনা “আমিই রাষ্ট্র” তথা “আমিই প্রতিষ্ঠান” নামক কোন ব্যাপার যেন কোন পাবলিক প্রতিষ্ঠানে না থাকে। কারও ব্যক্তিগত নিন্দনীয় ব্যাপারের সমালোচনা যদি সে যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার গোটা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা ধরা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে এটা চতুর্দশ লুইয়ের চেতনার কাজ হবে – যা একটি প্রজাতন্ত্রে/সাধারণতন্ত্রে সর্বাবস্থায় বর্জনীয়।
আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ আবৈধ ঘোষণার রায়ে দুই বিচারক বলেছেন –
“…constitution provides that the SC and the HC possess inherent power to summon anybody before them for committing contempt of court, and the administration will act in aid of the courts….”
“…The bench said those who have no idea about law and court proceedings should not be allowed to write whatever they wish on the proceedings…….”
“……The court cannot accept any comment on the ongoing trial proceedings, as criticism on any issue should be made within a periphery. The court is aware of the consequence of criticisms if those are made without adequate knowledge on the topics……”
বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হক এবং বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেন।
তবে অবশ্যই সংশোধন করত, ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আদালত অবমাননার আইন পরিবর্তন হতে হবে – একবিংশ শতাব্দীর একটি গণতান্ত্রিক সাধারণ তন্ত্রের উপযুক্ত করে। যেখানে স্পষ্ট থাকতে হবে কোনটা আদালত অবমাননা এবং কোনটা নয়। কাউকেই ফ্রি লাইসেন্স দেওয়া যাবেনা (যেমন ২০১৩ সালেরটাতে সরকারী কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছে।)
আমাদের বিচারপতিরা কি মনে করেন এটা সম্পর্কে একটু ধারনা পাওয়া গেল; এখন দেখা যাক পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের বিচারপতিরা কি মনে করেন –
“…… I think anybody can criticize the Supreme Court without any qualms. We do it enough in our dissents. So, I think people should feel perfectly free to criticize what we do. Some people, I think, have an obligation to criticize what we do, given their office – if they think we’ve done something wrong. So I have no problems with that (adverse comments toward my decision).”
বিচারপতি জন রবার্ট, ইউনাইটেড স্টেট সুপ্রিম কোর্ট, মার্চ ৯, ২০১০ এ এক বক্তব্য।
“……truth based on facts should be allowed as a valid defence, if courts are called upon to decide contempt proceedings relating to a speech or an article or an editorial in a newspaper or magazine unless such defence is used as a camouflage to escape the consequences of a deliberate attempt to scandalise the court…….”
বিচারপতি জি.এস. সিংভি এবং বিচারপতি অশোক কুমার, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট, আগস্ট ১৩, ২০১০ এর এক রায়ে।
“……a fair and reasonable criticism of a judgment, which is a public document or a public act of a judge concerned with the administration of justice, would not constitute a contempt of court. In the judges’ opinion, such fair criticism should be encouraged…….”
বিচারপতি জে.এম. পঞ্চাল এবং এ.কে. পাট নায়েক ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে।
প্রতিটি পেশাতেই কিছুনা কিছু অপ্রীতিকর বাস্তবতা এবং নিন্দনীয় কাজ থাকে, যা সাবধানতার সাথে বাহিরের মানুষ হতে গোপন রাখা হয়। নিজ নিজ পেশার গৌরব এবং গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য পেশাদারগণ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন এবং তা মানসে লালন করেন। এটা পেশাদারী দায়িত্বেরই অন্যতম অংশ। আসলে এটা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – রাষ্ট্রীয় সামাজিক অবস্থা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুচারু ভাবে বজায় রাখার জন্য এটা প্রয়োজন – এই নয় যে গোপন করে ক্ষতিকর অবৈধ কাজ সম্পাদন করা; এর মানে এই যে বাহিরের মানুষের কাছে পেশাগত কাজের ধারা সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতার সাথে প্রকাশ।
বিচারবিভাগ তথা উচ্চতর এবং নিম্ন আদালত রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মতই একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান – যার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেনা। বিচারবিভাগের উপর আস্থাহীনতা অর্থ রাষ্ট্রে নৈরাজ্য। কেউ এটাকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করলে এবং মানহানিকর বিস্বাদগার করলে তাকে আইনের আওতায় অবশ্যই আনতে হবে। তবে এই বিচার বিভাগে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা যদি কোন-ভুল ত্রুটি করেন তার সমালোচনা করা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। অবমাননার ক্ষমতা ব্যবহার পূর্বক, সামাজিক ন্যায়বিচার কিংবা মৌলিক মানবাধিকারকে দমন করার নিরিখে তা অস্বীকার করলে রাষ্ট্রের কর্মচারী রূপে থাকার অধিকার কারো নেই – এটা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ কিংবা বিচার বিভাগ যেটাই হোউক।