Friday, 2 December 2022
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি
বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই এক যুগে ব্যবসায়ীরা ৭০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।
অলস বিদ্যুৎ এর বোঝা—
১। গত ১১ বছরে কমপক্ষে ১০ দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
২। বিদ্যুতের দাম শুধুমাত্র বিদ্যুৎ খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। খাদ্যশস্য ও পরিবহন ভাড়াসহ বেড়ে যায় জীবনযাত্রার সকল ব্যয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুপরিকল্পিত দুর্নীতি, অপচয় এবং অব্যবস্থাপনার কারণেই বিদ্যুতের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ও চাহিদা
দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতার পরিমাণ ২৫ হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট।
সরকারি তথ্য অনুসারে গত ৯ এপ্রিল ২০২২ তারিখ দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৬শ ৪২ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১ হাজার ৩শ ৯০ মেগাওয়াট ।
বিদ্যমান কেন্দ্রের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের বেশিরভাগ সময় অলস পড়ে থাকে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। তবুও ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই বেশি বিদ্যুৎ কিনেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- বিপিডিবি।
ফলে সরকারি এই সংস্থাটির পরিচালন ক্ষতি গত অর্থবছরে দ্বিগুণ বেড়েছে। বড় এ ক্ষতি পোষাতে গত অর্থবছরে শুধু বিপিডিবির পেছনেই সরকারের দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা!
অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিদিন ১ হাজার ৩শ ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
২০২০ সালের ১৫ মে প্রথম কেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে আসে। দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বরে।
সঞ্চালন লাইন নির্মাণ পুরোপুরি শেষ না হওয়ার কারণে সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়নি।
বিদ্যুৎ বেসরকারীকরণ
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ বসিয়ে রেখে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো গত এক যুগে তুলে নিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্লানে মোট স্থাপিত সক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে না রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশের অধিক বিদ্যুৎ বসিয়ে রাখা হয়েছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কেনার কারণে গতবছর বিপিডিবি’র ব্যয় বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মার্কিন বিজনেস সাময়িকী ফোর্বস এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি পাওয়া ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরের ৩৪তম শীর্ষ ধনী। তিনি দেশের প্রথম ‘ডলার বিলিওনিয়ার’।
ভর্তুকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা এভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে কিছু কোম্পানির হাতে।
সক্ষমতার পরেও বিদ্যুৎ আমদানি অলস বিদ্যুতের বোঝা।
এক তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থাকার পরেও ভারত থেকে প্রায় প্রতিদিন ১ হাজার ১শ ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৮১২ কোটি ৮৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এক্ষেত্রে ব্যয় হয় চার হাজার ৭১২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
বর্তমানে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড- এনভিভিএন থেকে দুই ধাপে যথাক্রমে ২৫০ ও ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে বাংলাদেশ।
এছাড়া সেম্বকপ ইন্ডিয়া নামের আরেকটি কোম্পানি থেকে ২৫০ মেগাওয়াট, পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট ও ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়।
বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তি
১. বিদ্যুৎখাতের এই সব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের তদন্ত এবং শাস্তি এড়ানোর লক্ষ্যে দায়মুক্তি দিয়ে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) নামের একটি আইন।
২. বিশেষ আইনটি দুই বছরের জন্য প্রথম পাস করা হয়। এরপর চার দফায় ১৪ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎখাতে এই সব তৎপরতার ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে রাষ্ট্র। আর জনগণকে টানতে হচ্ছে অলস বিদ্যুৎ এর বোঝা।
Subscribe to:
Posts (Atom)