রাষ্ট্র
ব্যাবস্থার উদ্ভব নিয়ে চিন্তা
করলেই, রাষ্ট্রের নির্মম, নির্দয়, নগ্ন চরিত্রের প্রমান
পাওয়া যায়। রাষ্ট্রের
উৎপত্তির শুরু থেকে বর্তমান
কাল পর্যন্ত এই দানবীয় এবং
নারকীয় চরিত্র বিদ্যমান।চিরকাল ধনিক শ্রেনীকে
রক্ষা করে রাষ্ট্র শোষনের
হাতিয়ারে পরিনত হয়েছে।কালের বিবর্তনে গোত্র
থেকে রাষ্ট্র ব্যাবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছে পৃথিবীময়।
ইচ্ছে করলেই কোন রাষ্ট্র
কিংবা সমাজ এখন আর
গোত্র ব্যাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনা। পুঁজিবাদ
এমনি জেঁকে বসেছে, ব্যাক্তির
চিন্তা-চেতনা, সমাজ-সংসার
কিছুই এটি থেকে মুক্ত
নয়। রাষ্ট্রীয়
হস্তক্ষেপ সর্বময়, ব্যাক্তির জীবন, ধর্মীয় বিশ্বাস,
মানবের সম্পর্ক এমনকি চিন্তার স্বাধীনতায়।
বাংলাদেশ
নামক রাষ্ট্রটি একটি স্বৈরাচার, ডাকাত
এবং নির্যাতনকারীদের রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে।১৯৭১ সালে পাকিস্তান
রাষ্ট্রের শাসন-শোষণ থেকে
মুক্ত হয়ে এই বদ্বীপের
মানুষগুলো আরেকটি রাষ্ট্রের যাতাকলে
পতিত হয়। তথাকথিত
স্বাধীন বাংলাদেশ নামে আরেকটি শাসন-শোষনের খাচায় আবদ্ধ
হয়।মানুষগুলোর
ভাগ্যের হাত বদল হয়,
কিন্তু মুক্তি আর মেলেনা। মুক্তি
যেন সুদুর পরাহত, স্বপ্নে
আর কল্পনায় বাস করে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই নিজ ভূমির
ধনিক শ্রেণী কর্তৃক আবার
দানবীয় শাসনের খড়গ নেমে
আসে দুর্যোগের মত। শেখ মজিবের নেতৃত্বে ছিনতাই হওয়া রাষ্ট্রের কর্তিত্ব ধনিক শ্রেনীর হাতে পড়ে। সেই থেকে শুরু আজ অবদি চলছে। ৭৪'র দুর্ভিক্ষে এত মানুষ মারা গেল, রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই, দায় নেই শাসক শ্রেনীর।যখনি কিছু মানুষ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির হর্তাকর্তা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে, তখনি রাষ্ট্রযন্ত্র বলপ্রয়োগে তাদের হত্যা করেছে।বিপ্লবী সিরাজ সিকদার সহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে তত্কালীন শাসকবর্গ।রক্ষীবাহিনীর মত কুখ্যাত বাহিনী লেলিয়ে দিয়েও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি গণ মানুষের প্রতিরোধের মুখে।
মানুষকে শোষনের বেড়াজালে আবদ্ধ করার নিকৃষ্ট পদ্ধতিটি হচ্ছে ''ব্যাবসা''। ব্যাবসা মানেই পুঁজির সমাবেশ, আর পুঁজির সমাবেশ মানেই রাষ্ট্রের নির্লজ্জ উপস্থিতি। রাষ্ট্র ব্যাবসা করে নাগরিকের সাথে, রাষ্ট্র ব্যাবসা করে মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলো নিয়ে, রাষ্ট্র ব্যাবসা করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বেসরকারীকরণের নামে রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এলিট শ্রেনীর কাছে তুলে দেয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী ব্যাবসা করে, পুলিশ ব্যাবসা করে, সরকার ব্যাবসা করে কেবল সাধারণ মানুষ ঠকে। রাষ্ট্র রেকর্ডের পিছনে ছুটে, লাখ কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গায়। রাষ্ট্রযন্ত্র ভাত দিতে পারেনা, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। গণমানুষের শ্রমে, ঘামে আররক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠা রাষ্ট্রটি আজ দস্যু কবলিত।বাংলাদেশ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক চারণভূমিতে পরিনত হয়েছে। শাসক শ্রেণী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে নাগরিকদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু তারপরও এই ভুয়া শাসক শ্রেনীকে অবৈধ বলা যাবেনা। কারণ প্রতিবাদ করলেই তারা সন্ত্রাসী কিংবা রাষ্ট্র বিরোধী অভিহিত করে।
চিকিত্সা নিয়ে নির্লজ্জ ব্যাবসা, এই রাষ্ট্রটির অন্যতম চরিত্র। এখানে মানুষের চেয়ে জড় বস্তুর মুল্য বেশি। রাষ্ট্রের শাসকরা হাঁচি-কাশি, সর্দি হলেই সিঙ্গাপুরে উড়াল দেয় উন্নত চিকিত্সার জন্য, বাকি মানুষগুলো ধুকেধুকে মরছে নিরবে, নিভৃতে অবহেলায়। শাসকযন্ত্রের ছত্রছায়ায় এইখানে চিকিত্সা নিয়ে ব্যাবসা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বদা তথাকথিত ''কল্যাণকামী রাষ্ট্র '' ''গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র'' কিংবা সস্তা ''জাতীয়তাবাদের'' কথা বলে মানুষকে দাবিয়ে রাখে। রাষ্ট্র কি আদৌ কল্যাণকামী কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারে ? তথাকথিত উন্নত দেশ(আমেরিকা, যুক্তরাজ্য , জাপান , ফ্রান্স) কিংবা পুঁজিবাদী দেশগুলোকে কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা হয়। মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই কি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের একমাত্র বৈশিষ্ট ? ধনী দেশগুলো আর গরিব দেশ গুলোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, ধনী দেশগুলো নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে আর গরিব দেশগুলো করেনা। লক্ষনীয় ব্যাপার হলো, ধনী দেশ হোক আর গরিব দেশ হোক কোথাও গণমানুষের অংশগ্রহন নেই। আছে শুধু পুঁজিবাদের অবাধ স্বাধীনতা আর শোষিত হওয়ার উপলক্ষ। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই শাসন -শোষণ মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে।
বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি চরম হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে, যেখানে কৃষক শ্রেণী দুবেলা ভাত খেতে পারেনা, সেখানে ''জাতির জনক '' নামে এক ব্যাক্তির গুনগান গাওয়া হয়, গুনগান গাইতে বাধ্য করা হয়।রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের এক মহা উত্সবে সামিল হয়েছে শাসকবর্গ। পুঁজির সমাবেশ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় তারা লুটে নিচ্ছে মানুষের সম্পদ। সম্পদ সংগ্রহের এমন স্বাধীনতা ধনিক শ্রেনীকে আরো বেশি নীপিডক হতে সাহায্য করেছে। ব্যাঙ্কিং থেকে বিচারালয়, প্রশাসন থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় এই নীপিডকদের সরব উপস্থিতি। বিচারালয়, প্রশাসন এই নীপিডক শ্রেনীকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের
অন্যতম কূটকৌশল হলো জাতীয়তাবাদের ধুয়া
তোলা এবং বার বার
প্রচার করা। জাতীয়তাবাদের
মূলা ঝুলিয়ে মানুষকে প্রতিবাদ
এবং প্রতিরোধ থেকে দুরে রাখা। বাংলাদেশের
ডাকাত সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের
শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি
বলে সমাজকে বিভক্ত করে
শোষণ করে যাচ্ছে।
আর প্রতিরোধ, প্রতিবাদের চেষ্টা করলেই নিপীডন
করে স্তব্ধ করে দিচ্ছে।রাষ্ট্রযন্ত্রকে
টিকিয়ে রাখার জন্য আইন
শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামরিক
বাহিনী নিপিডকের ভূমিকায় নেমেছে। কোথাও
কোনো প্রতিরোধ নেই, আন্দোলন নেই
, নেই কোনো সংগ্রাম।
দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিরোধ
করার মত কোনো শক্তি
বাংলাদেশে আর অবশিষ্ট নেই। তরুণ
প্রজন্ম মদ, নারী আর
ইন্টারনেট নিয়ে ব্যাস্ত।
ভোগ করাই যেন মানব
জীবনের সার্থকতা। রাষ্ট্র,
সমাজ তরুণ প্রজন্মকে ভোগবাদী
করে গড়ে তুলছে।
এভাবে
আর কতকাল। শ্রেণী
সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে
দেখা যায়, প্রতিরোধ এসেছে
কৃষক শ্রেণী থেকে, গণমানুষ
থেকে। রাষ্ট্র
যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনো বৃথা যায়না,
হয়তো সাময়িক দাবিয়ে রাখা
যায় কিন্তু বিজয় নিশ্চিত। অবৈধ
রাষ্ট্রযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে যদি
সামরিক বাহিনী চেষ্টা করা,
প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে রুখে
দাড়াতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের
প্রতি উপাদানকে আঘাত করতে হবে,
আঘাতে আঘাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত
কাঁপিয়ে দিতে হবে।
গণমানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান। এই
রাষ্ট্রকে মুক্ত করে মানুষের
রাষ্ট্রে তথা
গণরাষ্ট্রে পরিনত করতে হবে।
লেখক : আজিমুল হক খান
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মানবাধিকার কর্মী