প্রচলিত একটি কথা আছে- সম্মান পেতে হলে, সম্মান দিতে হয়। প্রশ্ন- সিত্যই কী এক ধর্ম অন্য ধর্মকে যথেষ্ট সম্মান দেয়? ধর্ম কী কেবলমাত্র ভালো শিক্ষাই দেয়, নাকি খারাপ শিক্ষাও দেয়? যেসব শিক্ষায় মানুষ উগ্র, ধর্মান্ধ, কুসংস্করাচ্ছন্ন, জঙ্গি বা ধর্মসন্ত্রাসী… হচ্ছে (সংখ্যায় কম হলেও) তা কী ধর্মশিক্ষায় নেই? যদিও, কথিত সর্বশ্রেষ্ঠ, মহাসত্য, মঙ্গলময়, চিরসুন্দর, চিরশান্তি ও প্রেমের… ধর্মগুলোর মধ্যে একমাত্র ভালো গুণ ও শিক্ষাই থাকার কথা! কিন্তু আছে কী? যদি থাকতো, তাহলে প্রশ্ন উঠতো না, বিতর্ক কিংবা সমালোচনা হতো না। ধর্মের মধ্যে ভালো কিংবা মন্দ যা-ই থাক, না থাক, সেগুলো নিয়েও সমস্যা হতো না, যদি এর ব্যবহার/প্রয়োগ শুধু ভালোটুকুই হতো এবং ধার্মিকরা এর মন্দ শিক্ষাগুলো স্বীকার করে তা প্রচারে বিরত থাকতো। কিংবা ধর্ম যদি কেবলমাত্র সুশিক্ষাটুকুই দিতো, তাহলে ধর্ম না পড়লেও চলতো। সত্যিই যদি এক ধর্ম অন্য ধর্মকে কিংবা স্বধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠিকে আঘাত না দিয়ে শুধু প্রশংসা করতো, তাহলে প্রকাশ্যে, ধর্মানুষ্ঠানসহ রাস্তাঘাটে এবং ইউটিউবে যা দেখি ও শুনি, তা শুনতে ও দেখতে হতো কী? জানি না, এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ বিদ্বানগণ এতো নিরব কেনো? যারা এসব শুনতে/দেখতে পান না এবং এর প্রতিবাদ না করে বরং অবিশ্বাসী/সংস্কারবাদিদের সমালোচনা করনে, তাদের করুণা হয়। একটিবার প্রমাণ দিয়ে বলুন তো, কোন ধর্মালম্বীরা এ শিক্ষা দিচ্ছে যে- অন্য ধর্মালম্বীরাও আমাদের ন্যায় শ্রেষ্ঠ না হলেও অন্তত ভালো, তারাও প্রশংসার যোগ্য, তাদের ঈশ্বর ও ধর্মানুষ্ঠান ভালো, তাদের ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দেয়া দোষের কিছু নয়…? তাদের ধর্মকে নিজের ধর্মের ন্যায় সম্মান করতে হবে, তাদের প্রতি সহনশীল হতে হবে, অন্যায় আচারণ এবং হুমকি-ধামকি দেয়া যাবে না, ধর্মের মিথ্যা অজুহাতে নির্যাতন করা চলবে না, তাদের ধর্মকেও নিজেদের ধর্মের ন্যায় স্বীকৃতি দিতে হবে… এসব কোন ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে? বরং বলা হয়, যারা বিধর্মীদের প্রশংসা করবে, তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে, তারা নরকে যাবে, তাদের ধর্ম খারিজ হয়ে যাবে…। কারণ (ধর্মের বদ্ধমূল ধারণা) এসব বললে/করলে নিজ ধর্ম, ধর্মাবতার এবং ঈশ্বরকেই ছোট করা হয়, নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, গর্ব, অহমিকা-অহংকার… বজায় থাকে না (যা ধর্মের অন্যতম কঠিন শিক্ষা)। অথচ অনেক বিজ্ঞজনেরাই এসব শিক্ষা বন্ধ করার কথা না বলে বরং বারবারই অবিশ্বাসীদের উপর খবরদারি চালাচ্ছেন, পক্ষান্তরে যা ধর্মের পক্ষেই সাফাই গাওয়া। যা প্রচণ্ড রকমের ভুল। যে ভুলের কারণেই ধর্মসন্ত্রাস, অসমপ্রীতি, সংখ্যালঘু নিধন (স্বরবে ও নিরবে)… না কমে বরং বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র তাদের এ বুদ্ধিহীনতার (ধর্ম বিষয়ে) কারণ, ধর্মপুস্তক না পড়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে নিজেকে এবং কুবিশ্বাসকে নিরাপদে রাখা। যদি (সঠিক ও প্রশ্নসহ) পড়তেন তাহলে, বোধকরি এমন বক্তব্য দিতে পারতেন না। অস্বীকার করার উপায় নেই, ধর্মগুলো মানুষকে কেবল সুপ্ররোচনাই দেয় না, কুপ্ররোচনাও দেয়। যার সামান্য একটু দিয়েই দানব সৃষ্টি করা সহজ। অতএব, এ কুপ্ররোচনা যে পর্যন্ত শূন্যের নিচে নামাতে না পারবেন, সে পর্যন্ত রামু-উখিয়া, নাসিরনগর, সাঁথিয়া, সাঁওতাল নির্যাতন… থেমে থেমে ঘটতেই থাকবে এবং বিশ্বের কোথাও কেউ নিরাপদে থাকতে পারবে না। আর এজন্যই ধর্মপুস্তক পড়ার এবং এর ভুলত্রুটি, কুসংস্কারগুলো প্রকাশ্যে প্রচারের কোনো বিকল্প নেই।
“সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই” এটিও বহুল প্রচারিত বাক্য। এ মূর্খের অনুধাবন, বাক্যটি আংশিক সত্য। কারণ সাধারণ সন্ত্রাসী বা অর্থসন্ত্রাসী সৃষ্টির পেছনে ধর্ম নাও থাকতে পারে কিন্তু ধর্মসন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদের পেছনে অবশ্যই আছে। অর্থাৎ ধর্মসন্ত্রাসী থেকে ধর্মকে আলাদা করার কোনোই সুযোগ নেই। যারা আলাদা করে দেখেন, তারা মিথ্যাবাদী। কারণ ধর্মসন্ত্রাসী এবং অন্যান্য সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য (যা বুঝতে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই)। ধর্মসন্ত্রাসীরা ধর্মমন্ত্রে উজ্জীবিত ও উম্মাদ, সাধারণ সন্ত্রাসীরা সেরকম নয়। ধর্মসন্ত্রাসীদের ধর্মগুরু থাকে এবং ভাড়ায় খাটে না; সাধারণ সন্ত্রাসীদের থাকে না (নেতা থাকে) এবং ভাড়ায় খাটে। তাছাড়া একমাত্র কট্টোর জাতিয়তাবাদ ব্যতিত আত্মঘাতি বানানো সহজ নয়; কিন্তু বহু ধার্মিককেই অতি সহজেই আত্মঘাতি বানানো সম্ভব। কারণ আত্মঘাতি সৃষ্টির বহু উপাদান/ঐশ্বী প্রলোভন ধর্মমন্ত্রে রয়েছে (লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি…) কিন্তু সাধারণ সন্ত্রাসীদের আত্মঘাতি বানানোর কোনো ঐশ্বী প্রলোভন নেই (সেজন্য এ চেষ্টাও কেউ করে না)। সাধারণ সন্ত্রাসীরা মূলত জাগতিক অর্থ-বিত্তের লোভে (বোধকরি বেশিরভাগই সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর বেকারত্বের কারণে) সন্ত্রাসী হয়। কিন্তু ধর্মসন্ত্রাসীরা বিশেষ একটি কারণেই হয়, অর্থাৎ পরকালের মহাসুখের আশায় (যার উৎস ধর্মপুস্তক), এদের কাছে জাগতিক অর্থ-বিত্ত তুচ্ছ; সাধারণ সন্ত্রাসীদের কাছে যা মূখ্য। আবার সাধারণ সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করলেই অপারেশনে যায়, বেশি একটা ঝুকি নেয় না, পালাবার সুযোগ না পেলে আত্মহত্যা করে না। অথচ ধর্মসন্ত্রাসীরা নিজেরা মৃত্যুর জন্য প্রস্থত হয়েই অপারেশনে নামে এবং হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে পালাবার সুযোগ না পেলে আত্মহত্যা করতেই বেশি পছন্দ করে; কারণ অন্যের হাতে মৃত্যুর চেয়ে আত্মহত্যাই বেশি সম্মানের মনে করে। সেজন্যই সাধারণ সন্ত্রাসীদের দিয়ে কাজ করাতে হলে প্রচুর নগদ অর্থ ব্যয় করতে হয়। পক্ষান্তরে ধর্মসন্ত্রাসীদের জন্য নগদ অর্থের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না (প্রায় পুরোটাই বাকিতে, কারণ ওপারে গেলেই নগদে সব মিলবে); শুধু মগজ ধোলইটা ঠিকমত হলেই কেল্লাফতে (প্রমাণস্বরূপ, পত্রিকায় প্রকাশিত সীতাকুন্ডতে ধৃত জঙ্গি দম্পতির বক্তব্য পড়তে পারেন)। আর এ মগজ ধোলইয়ের প্রাথমিক ধর্মশিক্ষা পূর্বেই (শিশুকালে) দেয়া থাকে। অতএব হলফ করেই বলা যায়, ধর্মসন্ত্রাসী বানানোর মূল উপাদানই হচ্ছে- ধর্ম। এরপরও যারা বলেন, “সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই” তারা ডাহা মিথ্যা বলেন। অথবা সমাজের চোখে ভালো মানুষ সেজে কিংবা হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কেবল লা-লা-লা-লা-লা… করেন এবং সত্য এড়িয়ে যান। মূলত যাদের ধর্ম নেই (অবিশ্বাসীরা) তারা কখনোই ধর্মসন্ত্রাসী তথা দানব হবে না, এ নিশ্চয়তা শতভাগ।