পড়ে, বুঝে, প্রশ্নোত্তরসহ যাহা শিখি তাহলো- বিদ্যা। না পড়ে, না বুঝে, প্রশ্নহীনভাবে যাহা শিখি তাহলো- ধর্ম। সম্ভবত ধর্মই একমাত্র বিষয়, যা না পড়ে কিংবা পড়ার বয়স হওয়ার আগে, তথা নিজের অজান্তেই মানুষ শিখে ফেলে বা বিশ্বাস করে। যেহেতু মানুষ ধর্মসম্পর্কিত বিষয়গুলো না পড়ে, না বুঝে, যাচাই-বাছাই না করেই… বংশানুক্রমে বিশ্বাস করে; সেহেতু এতে বিভ্রান্তি থাকবেই। প্রশ্নহীন এ শিক্ষার সুফল থাকলেও কুফল মোটেও কম নয়; যা সমস্ত মানবজাতিকেই ভোগ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, ধর্ম ছাড়া প্রায় সব বিষয়গুলোই কষ্ট করে পড়তে হয়, প্রশ্নোত্তর দিতে হয়… এরপর বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। অথচ যা প্রশ্নোত্তরসহ পড়িনি কিংবা পড়ার প্রয়োজনবোধও করিনি, সেটাকেই খাঁটি ও মহাসত্য বলে মানতে হচ্ছে। তথাপিও প্রশ্নও করি না, যে- ধর্ম নিয়ে সারা পৃথিবীতেই কেনো এতো বিতর্ক, অশান্তি, রক্তপাত, দল-উপদল, হিংসা-বিদ্বেষ, হুমকি-ধামকি, যুদ্ধ-দাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ…?
ফলে ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটামাত্র, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বসহ প্রায় সব শ্রেণিপেশার মানুষই সমস্বরে বলতে শুরু করেন, “ধর্মের কী দোষ!” কিংবা “জঙ্গিবাদ/সন্ত্রাসের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই!” বুঝি না, সম্পর্ক না থাকলে ধর্মসন্ত্রাসী জন্মে কীভাবে? কারণ যাদের সাথে ধর্মের সমপর্ক নেই, সেইসব অবিশ্বাসীরা কখনো ধর্মদানব (জঙ্গি) হয় না, বরং বিশ্বাসীরাই হয়। প্রশ্ন হলো- যা মহাপবিত্র(!), সর্বশ্রেষ্ঠ(!) কঠিন এবং অপরিবর্তিত সত্য, কলঙ্কহীন, বিতর্কহীন, নির্মল, বিশুদ্ধ, খাঁটি, নির্ভেজাল(!)… তার কী দোষ থাকতে পারে? না থাকুক, সেটাই চাই। কিন্তু হায়! চাই বা না চাই- বিতর্ক, বিভ্রান্তি, দলাদলি থেকে হানাহানি, খুনাখুনিসহ নির্মম-নিষ্ঠুরতম ও সম্পূর্ণ ঠাণ্ডামাথার হত্যাযজ্ঞের সিংহভাগই কিন্তু ধর্মের নামেই হচ্ছে (রাজনৈতিক যুদ্ধ বাদে)। ধরে নিলাম, যারা এসব করছে বেশিরভাগ মানুষই তাদেরকে ধার্মিক বলতে নারাজ। কিন্তু এটা স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায়, এরাও কোনো না কোনো ধর্মগোষ্ঠি, যারা এ সমাজেরই ধর্মশিক্ষকদের হাতে গড়া। ধার্মিক পিতা-মাতার সন্তান এবং ধর্মশিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার, সমাজ, ধর্মালয়ে… যা বংশানুক্রমেই চলে আসছে। অতএব এ শিক্ষার সংশোধন কিংবা সংস্কার না করে জঙ্গিবাদ নির্মূল কীভাবে সম্ভব, বোধগম্য নয়। অথচ অবিশ্বাসীরা সামান্য সমালোচনা করলেই অনেকেই ক্ষেপে ওঠেন। দুঃখ একটাই, অবিশ্বাসীদের উপর দোষ চাপাবেন, তথাপি একটিবারও ধর্মপুস্তক পড়ে দেখবেন না, কোনো ধর্ম নিয়ে তারা সমালোচনা করছে! কারণ যা সত্য, বিশুদ্ধ, খাঁটি, ভুল-ত্রুটিমুক্ত… তা নিয়ে কারো মাথাব্যথার কথা নয়, অবিশ্বাসীদের তো নয়ই। আছে বলেই প্রশ্ন তুলছি।
অনেকেই বলছেন, ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করলে মানুষ আঘাত পায়, আঘাত দিয়ে লেখা উচিত নয়… (আমরাও বুঝি)। প্রশ্ন হলো- মনের আঘাতের চেয়ে কী শারীরিক আঘাত কিংবা হত্যাযজ্ঞ ভালো? আবার রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ধর্ম থাকার পরও বলছেন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার ইত্যাদি (এটা কী হাস্যষ্কর এবং খলনায়কসুলভ বক্তব্য নয়)। এরকম বক্তব্য শুনে মনে হয়- ধর্মের কুসংস্কারগুলোর সমালোচনায় ধার্মিকদের যতোটা আঘাত লাগে, হত্যাযজ্ঞে ততোটা লাগে না। দেশি-বিদেশি বুদ্ধিজীবিসহ রাষ্ট্রনায়কগণের এসব বক্তব্য শুনতে শুনতে যদিও কান ঝালাপাল। তথাপিও এ মূর্খ মনেপ্রাণে চাইছে, আপনারা যা বলেন, তাই-ই যেন হয়! অর্থাৎ ধর্ম যেন শান্ত থাকে, সুন্দর থাকে, চিরজীবি হয়, এর অনুকরণে, অনুসরণে যেন একটা দানবও সৃষ্টি না হয়…! ধর্মকে যেন একজনও সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার না করে, বিধর্মীই শুধু নয়, স্বধর্মী বিভিন্ন গোষ্ঠির প্রতিও যেন সহশীল থাকে…! (কারণ মানবতার দৃষ্টিতে ধর্ম অপ্রয়োজনীয় হলেও, তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই এ ছাড়া বাঁচার কথা কল্পনাই করতে পারে না)। সেহেতু আরো চাই, দানব সৃষ্টির যেসব সুযোগ ধর্ম নিজেই করে রেখেছে, তা যেন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে। যদিও চোরে যেমন শোনে না ধর্মের কাহিনী; ধার্মিকরাও বুঝতে চাইবে না ধর্মের বুজরুকি! তবে বুদ্ধিজীবিসহ রাষ্ট্রনায়কগণ যেভাবে অবিশ্বাসীদের উপর খবরদারি করছেন, এর সিকিভাগও যদি ধর্মের প্রতি করতেন, অর্থাৎ ধর্মশিক্ষার সীমা ও সিলেবাস নির্ধারণ করে দিতেন, বিধর্মী/ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণাত্মক কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, উষ্কানি ইত্যাদিতে বাধা দিতেন, অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভিন্নধর্মকে আক্রমণ ও সমালোচনার কারণে কঠিন শাস্তি দিতেন…। যদি সব ধর্মের সমালোচনা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হতো, তাহলে হয়তো জঙ্গিবাদ নির্মূল না হলেও অতি দ্রুত কমে আসতো বলে এ মূর্খের ধারণা। যদিও ধর্ম সমালোচকদের বিরুদ্ধে আইন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ স্পষ্টতই একপেশে। কারণ এর প্রয়োগ কেবল দুর্বল বিধর্মী এবং অবিশ্বাসী/নাস্তিকদের বেলায়, ধর্মপ্রচারকদের বেলায় মোটেও নয়। কারণ তারা খোলামেলাভাবেই প্রচণ্ড ধর্মসমালোচক (ভিন্নধর্ম ও মতের)। উৎপাদন ও বিপণন চালু রেখে কেবল উপদেশ দিয়ে যেমন নেশাগ্রস্তদের নেশামুক্ত করা সম্ভব না, তেমনি ধর্মের অপপ্রচার তথা কট্টোর/গোড়ামিপূর্ণ শিক্ষা বন্ধ না করে, কেবলমাত্র আইনের পর আইন করে কিংবা ক্রসফায়ার অথবা যুদ্ধ ঘোষণা করে ওদের নির্মূল করা সম্ভব নয়। অতএব, যে ফ্যাক্টরিতে ধর্মসন্ত্রাসী তথা জঙ্গিদের জন্ম, সেখানে নিয়ন্ত্রণ/নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।