Monday, 30 September 2024
ঢাকা শহরের আবাসন এর অর্থনীতি।
ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় বাড়ির ভাড়া অত্যাধিক সস্তা।
সস্তা বলছি বাড়ি বানানোর খরচ আর আনুপাতিক দ্রব্যমূল্যের নিরিখে। সিটি সেন্টারের বাইরের জায়গাগুলোত (যেটা নগরীর প্রায় ৮০% জায়গা) একটা জমি কিনে বাড়ি বানাতে প্রায় ১.৬ কোটি টাকা খরচ হয়।
দেড় কাঠা জমির উপর, গলির ভেতর একদম সাদামাটা পাঁচতলা বাড়ি। তার একটাতে গৃহস্বামী বাস করেন, বাকি চার তলা ভাড়া দেন। ভাড়া এসব ক্ষেত্রে ১৫-১৬ হাজারের বেশি হয় না। পুরো বিল্ডিং থেকে আয় সর্বসাকুল্যে ৬০ হাজার টাকা (খাজনা বাদ দিয়ে)।
এই হিসেবে কেবল আপনার দেড় কোটি টাকা উদ্ধার করতেই লেগে যায় ২২ বছর ৩ মাস। আর যদি ১০০% মুনাফা করতে চান তবে সাড়ে চুয়াল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এর মাঝে মেরামত খরচ আর চাঁদাবাজির সাথে মুদ্রাস্ফীতি কাটাকুটি করে দিলাম।
যাইহোক, ১.৬ কোটি টাকাকে বাড়ি বানানোর মাধ্যমে দ্বিগুণ করতে গৃহস্বামীর ৪৪.৫ বছর সময় লাগে। বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ ব্যাংকে, সবচেয়ে কম সুদে ফিক্সড ডিপোজিট করলেও এই টাকা দ্বিগুণ হতে ১২ বছর লাগে। এর মানে বাড়ি না বানিয়ে টাকাটা ব্যাংকে ফেলে রাখা ৪ গুণ বেশি লাভজনক। ফ্ল্যাট কেনার কথা তো বাদই দিলাম। ফ্ল্যাটের ইউটিলিটি চার্জ হিসাব করলে, এটা ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়েও ৮ গুণ খারাপ কাজ।
কিন্তু অন্যদিকে, আমি নিজে যখন ভাড়াটিয়া হিসেবে ভাড়া শোধ করতে যাই তখন আবার গায়ে লাগে। মনে হয় ভাড়াটা বেশি। তখন আর সস্তা মনে হয় না। এই শহরের ৯৬% মানুষের আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটা ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ায় (২০২০ সালের হিসাব যদিও)।
বাড়িওয়ালা মরছে, ভাড়াটিয়াও মরছে। তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
সমস্যা নির্মাণ সামগ্রীতে। একটা ইট বানাতে গড়ে খরচ হয় ৫ টাকা। সেটা ঢাকায় বিক্রি হয় ১৫ টাকায়, চট্টগ্রামে ১৬-১৭ টাকায়। অন্তত ৩০০% মুনাফা। এ কারণেই সাধারণ মানুষ বা ভালো মানুষ ইট ভাটার ব্যবসায় ঢুকতে পারে না। মহা লাভজনক এই ব্যবসায় গুণ্ডা না হলে টেকা সম্ভব না। আমরা জানি ইট ভাটার মালিকরা কেমন। আর শ্রমিকদের তারা কী ট্রিটমেন্ট দেয়। বালু মহলগুলোর অবস্থা আরও পৈশাচিক।
৫০০ ডব্লিউ টিমটি রডের টনপ্রতি উৎপাদন খরচ ৭০-৮০ হাজার টাকার মধ্যে। এটা বিক্রি হয় ১.১ লাখ টাকায়। সোনার ভরি আর রডের টন এখন প্রায় কাছাকাছি। এই রড উৎপাদকরা ইটের ভাটার মালিকের মত ২০০% মুনাফা না করলেও তাদের সার্বিক মুনাফা ইটের ভাটার মালিকের চেয়ে কয়েক হাজারগুণ বেশি।
কারণ ২০০% মুনাফা খায় প্রায় কয়েজ হাজার ইট ভাটা মালিক। আর রড বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ আর কার্টেল করে ৮-১০ টা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এ কারণে তাদের থাবার গ্রাস অনেক বড়। একই ইন্ডাস্ট্রির মালিকই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলে। ফলে শুধু রড না; সিমেন্ট, রঙ, কাঁচ, বৈদ্যুতিক তারসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষ ২০টি পরিবারের কাছ থেকে আমি আপনি সবাই নির্মাণসামগ্রী কিনি।
এই মুনাফার পরিমাণ আমেরিকাতেও প্রায় একই। তাহলে আমেরিকাতে আমাদের মত সমস্যা হয় না কেন? কারণ আমেরিকান ট্যাক্সেশন খুব কড়া, টাকা পাচার করা কঠিন, শ্রমিকের নায্য মজুরি আছে। ফলে ট্যাক্স আর মজুরির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের খেয়ে ফেলা সামাজিক পুঁজির একটা বড় অংশ আবার সমাজেই ফিরে আসে। এটা বাংলাদেশের বেলায় ফিরে আসে না।
ঢাকা শহরের বাড়ির ভাড়া বাড়িওয়ালাদের দিক থেকে খুব কম, আবার ভাড়াটিয়ার জায়গা থেকে খুব বেশি। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। ৮০% এলাকার তুলনায় বাকি যে ২০% এলাকা আছে, যেগুলো বড় রাস্তা বা মেট্রোরেলের কাছে বা ঢাকার অভিজাত - এসব এলাকাও প্রায় পুরোপুরি হাউজিং কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ঘুরে ফিরে আবারও সেই শীর্ষ ২০ ধনী পরিবার।
ঢাকায় আপনার করা বাড়ি বা ফ্ল্যাট যদি একটা একশো টাকার নোট হয়, তবে সেই নোটের ৫ পয়সার সুবিধাভোগী ভাড়াটিয়া, ৩০ টাকার সুবিধাভোগী বাড়িওয়ালা। ৪.৯৫ টাকার সুবিধাভোগী স্থানীয় এমপি, সিটি কর্পোরেশন, রাজস্ব বিভাগ ইত্যাদির অসাধু কর্মচারীরা। আর কেকের বড় অংশটা, প্রায় ৬৫ শতাংশ সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী কার্টেলগুলো।
এই গেলো ঢাকা শহরের আবাসন এর অর্থনীতি।
চাহিদা থাকলে পরে ঢাকার আবাসন মনস্তত্ত্ব আর নৃতত্ত্ব নিয়ে লিখবো নে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment