মুরগীর খোপে আমার দিনলিপি। পর্ব-৫
মুরগির খোপ ছেড়েছি প্রায় বছর খানেক হলো। সেইসব বৈচিত্রময় দিনগুলো আজো আমার হৃদয় মানসপটে অম্লান। বঙ্গদেশ থেকে আগত মুরগিরা মুরগির খোপকে বৈচিত্রময় করে তুলেছেন তাদের চিন্তা এবং প্রাত্যহিক কর্ম দিয়ে।
সকালে মুরগিদের হাঁক ডাক আর শুনিনা, আকাশ-পাতাল সমতুল্য চাপাবাজি, নিত্য বিবি তালাকের ঝগড়া, মূর্খ আমিলিক-বিম্পির নেতাদের সস্তা গল্প, দ্বিতল খাটে শুয়ে প্রেমিকার কাছে ফরাসি দেশ কিনে ফেলার গল্প। একসময় এসব শুনে বিনোদিত হতাম।
চালন বাটি করা লাগবো
........................................
এইতো কিছুদিন আগে প্যারিসের বাঙালি পাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে‘র রাস্তা দিয়ে হাটছি। মাঝ বয়সী বাঙালি চাচা আমার সামনে দিয়ে দ্রুত হেটে যাচ্ছেন, এক হাতে বাজার সদাইয়ের ব্যাগ অন্য হাতে ফোনে কথা বলছেন। ফোনের অপর প্রান্তের লোকটির উপর চাচা খুব বিরক্ত। বুঝলাম বাসায় যাওয়ার খুব তাড়া, পারলে হাওয়াই জাহাজে চড়ে যেতে চান। কিন্তু কেন এতো তাড়া ?
কিছুটা বিরক্ত হয়েই চাচা ফোনে লোকটিকে বললেন
“হেটার ঘরর হেটা, খল দেয়ার আর টাইম পাইসসনা। ঘরো গিয়া চালন বাটি করতাম, বাদে মাতুমনে। “
বুঝতে আমার আর অসুবিধা হলোনা, চাচা একটি মুরগীর খোপের দায়িত্বে আছেন, মুরগীর খাদ্য বন্টনের মহান কর্মে নিয়োজিত। রাত ১০ টা বাজলে মুরগীরা খোপে ফিরতে শুরু করে। তার আগেই ছোট ছোট বাটিতে চালন (তরকারি) বন্টন শেষ করতে হবে। তরকারি সমভাবে বন্টন না হলে মুরগীদের মধ্যে কাজিয়া লাগার সম্ভাবনা আছে। এমনকি এ কাজিয়া রাতের ঘুম নষ্ট করে খুনোখুনি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। তবে মুরগী ব্যবসাtয়ীরা কাজিয়া বাড়তে দেননা।
মুরগির খোপে রাজনীতি
........................................
সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে গিয়ে বসতি গড়ে তোলে। সেইসাথে নিয়ে যায় নিজস্ব সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ।
বাঙালি পৃথিবীর যে দেশে গিয়েছে, সে দেশেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গিয়েছে। শুনেছি পরবর্তী টার্গেট নাকি চাঁন্দের দেশ। ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপানে আমিলিক-বিম্পির রাজনীতির পর এবারের টার্গেট নাকি উগান্ডা আর ঘানা !!!! তো মুরগির খোপ কেন রাজনীতির বাহিরে থাকবে। মুরগির খোপে আমার থাকার বন্দোবস্ত হবার পর বুঝলাম দুই ধরণের রাজনীতির চর্চা হয় এখানে। প্রথমত, মুরগির খোপের আধিপত্য এবং ঘুমের বেপারীকে তেল মারার রাজনীতি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ -বিএনপির রাজনীতি।
মুরগির খোপে গ্রূপিং থেকে রাজনীতির সূত্রপাত হয়। অনেক কারণে গ্রূপিং হয় যেমন আঞ্চলিকতা, আমিলিক-বিন্পি এবং কাগজধারী সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে মুরগি ব্যবসায়ীর কান ভারী করে। অমুকের তরকারি মজা হয়নি, একজনের চালন আরেকজন খেয়ে ফেলছে, টয়লেট ব্যবহার করে ফ্ল্যাশ করেনি, নাক ডাকা সহ এমন অভিযোগ এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায়ই করে। তবে ঘুমের বেপারী (মুরগি ব্যবসায়ী) এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ। ঘুমের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে নিরপেক্ষ থাকতেই হবে।
পুলিশে ধরবে
....................................
ফ্রান্সে বাঙালি সমাজে স্বদেশী কুতুবদের কাজকর্ম অত্যন্ত হাস্যকর। কুতুবদের কেউ কেউ নিজেকে আওয়ামীলীগের, কেউ বিএনপির, কেউ কমিউনিটি নেতা দাবি করে। কেউ মুরগী পালন করেন, অনেকে সাংবাদিক ( পড়ুন সাংঘাতিক) লালন পালন করে, আবার কেউ চামচা পোষে। একজন আরেকজনকে ভয় দেখিয়ে নিবৃত করে, অনৈতিক সুবিধা আদায় করে। মুরগীর খোপে পুরাতন মুরগীরা নতুন মুরগীকে ভয় দেখায়, নতুন কেউ আসলে সবাই মিলে মিশে ভয় দেখায়। এটা করবেননা, সেটা করবেননা, করলে পুলিশে ধরবে।
ফরাসি দেশে আসার আগেই আমি রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন এবং পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে আসি। কেনো এসব তথ্য আমি জানি, এ নিয়ে মুরগির খোপের আদি বাসিন্দাদের প্রবল ক্ষোভ !!! কেনো আমি তাদের কাছে তথ্য জানতে চাইনা !!!
নতুন মুরগীকে(মেস মেম্বার) দিয়ে রান্নার কাজ করানো প্যারিসের বাংলাদেশী মেস গুলোর অন্যতম বদঅভ্যাস। কিছুদিন আগে নোয়াখালীর একজনের সাথে কথা হলো এ বিষয়ে। ৬ বছর আগে তিনি ফ্রান্সে আসেন। এসেই তিনি মুরগির খোপে উঠেন, পুরাতন মুরগিরা তাকে ঘর থেকে বের হতে দিতোনা পুলিশের ভয় দেখিয়ে। অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে তিনি তাঁর মেসের মেম্বারদের সম্পর্কে বললেন “ মা******র হুতেরা আঁরে দি ৩ মাস ভাত রান্দাইছে” 😁 (অর্থাৎ মা******র পোলারা তাকে দিয়ে প্রতিদিন রান্না করিয়েছে।) মেসের কথা উঠলেই তিনি গালি দেন। মনে তার অনেক ক্ষোভ, ব্যথা। মুরগির খোপের মালিক এবং মুরগি ব্যবসার প্রতি তার আজন্ম ঘৃণা।
হারামি খোর
......................
ফরাসী দেশে বাঙালি সমাজে একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো ”হারামি খোর”😁 যারা সরকারি ভাতা খায় তাদেরকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সহজ বাংলায় এটা হলো “বেকার ভাতা“
অনেকে বছরের পর বছর বেকার ভাতা খেয়েই যাচ্ছে কাজ কর্ম ছাড়া। অনেকে আবার সরকারকে ট্যাক্স না দিয়েই নগদ বেতনে কাজ করছেন সাথে বেকার ভাতাও পাচ্ছেন। যারা “বেকার ভাতা“ পাননা অথবা ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন, তারাই মূলত “হারামি খোর“ বলে অভিহিত করেন। আবার ব্যক্তিগত রেষারেষির এবং প্রতিহিংসার কারণেও একজন আরেকজনকে ”হারামি খোর” বলেন। মুরগি খোপে এই বিষয়ে বহু বিতর্ক এবং ঝগড়া বিবাদ হতে দেখেছি। ২০১৬ সালের দিকে আমার দ্বিতীয় মুরগির খোপে এ নিয়ে বিশাল বিরোধের সূত্রপাত হয়েছিল। বিতর্ক সহিংসতায় রূপ নিলে, মধ্যরাতে আমাকে মধ্যস্থতা করে দুপক্ষকে শান্ত করতে হয়েছে।
টাহা দিয়া খাইতেয়াছি
..............................
খেলাধুলায়, ব্যবসায় কিংবা নির্বাচনে প্রতিযোগিতা আমরা প্রায়ই দেখি। এটা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফরাসি দেশে বাঙালি মুরগির খোপে খাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা আমাকে আশ্চর্য করেছে। কে কার চাইতে বেশি খাবে তা নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা !!!
৬ জনের মুরগির খোপে ৫ কেজি মাংস মুহূর্তেই নাই !!!
তাজ্জব হয়ে গেলাম 🙄 রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে “ডক ডক ডক“ করে গ্লাসে দুধ খাচ্ছে !!!
এরপর একজন আরেকজনকে দোষ দেয় “অমুকে বেশি খায়, তমুকে বেশি খায়” । মুরগিদের মনোভাব ”টাকা দিয়ে খাই, কম খামু কেনো” !!!!
প্রতিযোগিতা করে খাওয়া নিয়ে একদিন মুরগির খোপে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো। সকাল ৮ টা, গভীর নিদ্রা মগ্ন আমি। হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলো মুরগিদের হাঁকডাকে। কান খাড়া করে শুনলাম দুধ খাওয়া নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত। কেউ একজন দুধ বেশি খেয়েছে, সকালে অন্যদের জন্য নাই, তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। তিনজন মিলে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে “বেশি দুধ“ খায় বলে। তবে আমার মনে হলো “অভিযুক্ত ব্যক্তি“ রাজনীতি কিংবা ষড়যন্ত্রের শিকার। সাতসকালে আমি প্রস্তাব করলাম এ বিষয়ে রাতে রাতে বৈঠক হবে। অভিযোগকারী তিনজন এটি মেনে নিতে নারাজ, তাদের দাবি একটাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যেন মুরগির খোপ থেকে বের করে দেয়া হয়। অবশেষে রাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো ”নাস্তা” উঠিয়ে দেয়ার। পরে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম “মুই টাহা দিয়া খাইতেয়াছি, মাগনা খাই ?”
সম্বাদিক বনাম সাংবাদিক
........................................
প্যারিসে বাংলা সাংবাদিকতার সংজ্ঞা : মানুষের মুখের সামনে বুম/মাইক ধরে ভিডিও করাকে সাংবাদিকতা বলে। ধারণকৃত ছবি এবং ভিডিও পরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ”ইউরো ভর্তি খাম” নেয়াকেও সাংবাদিকতা বলে। 😁
চারিদিকে শুধু সম্বাদিক, কিন্তু সাংবাদিক দেখিনা। গত কয়েক বছরে ফ্রান্সে বাংলা সাংবাদিকতার বাম্পার ফলন হয়েছে। প্যারিসের অলিতে-গলিতে বাঙালি সম্বাদিক। সবাই শুধু সম্বাদিক হতে চায় !!! ফেইসবুক লাইভের সম্বাদিক, অনলাইন পোর্টালের সম্বাদিক, টেলিভিশন চ্যানেলের সম্বাদিক। সম্বাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে অনেকে গৌরব বোধ করেন।
অনেকের মতে প্যারিসে বাংলা “সাংবাদিকতা” একটি গালি। সাংবাদিকতার অপর নাম চ বর্গীয় গালি 😁
“সাংবাদিকতা”র পশ্চাৎদেশ মেরে দিয়েছেন এই বিশিষ্ট সম্বাদিকরা 😁। সেদিনই বুঝেছি সাংবাদিকতা ধর্ষিত হয়েছে, যেদিন ভাতের হোটেলের মালিক এবং মুদি দোকানদারকে বানিয়েছে অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক !!!
ফরাসি দেশে আসার পর কয়েকটি সভা-সেমিনারে গিয়ে “সম্বাদিক“ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।সভা শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ভিডিও/ছবি ধারণ করেন। দুই /তিনটা প্রোগ্রাম একসাথে থাকলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন এবং যাওয়ার সময় আয়োজকদের বলে যান “আচ্ছা ভাই দেখা হবে“😁 অর্থাৎ “টাকা ওয়ালা খাম“ সম্পর্কে কিছু বলেন 😁 আয়োজকরা চুপি চুপি একটা কোনায় গিয়ে “খাম“ হস্তান্তর করেন অথবা বলেন “আচ্ছা আমি বিকেলে দেখা করবো“ 😁😁😁
প্যারিসে সাংবাদিকতার (পড়ুন সম্বাদিকতা) ব্যবসা চলে মূলত টেলিভিশনে খোমা দেখানো নিয়ে। কমিউনিটি নেতা নামক বীর পুঙ্গব গুলো টেলিভিশনে খোমা দেখালেই খুশী 😁। টেলিভিশনে প্রবাসী নিউজে ২০ সেকেন্ড দেখালেই সফল। খুশীতে গদ গদ হয়ে সম্বাদিক নামের প্রাণী গুলোকে টাকা দেয়। দুই পক্ষই খুশী !!! পরেরদিন কমিউনিটি ন্যাতা-খ্যাতা গুলো নিজের ফেসবুকে ওই নিউজ শেয়ার করে। এতেই নিহিত সুখ। এটাই সমাজ সেবা !!! সম্বাদিক খুশী, নেতাও খুশী 😁
মাস ছয়েক আগে এমনি এক সম্বাদিকের সাথে দেখা হলো বাঙালিপাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে। স্বল্প পরিচিত এক লোক পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশিষ্ট সম্বাদিকের সাথে !!!! জিজ্ঞেস করলাম কোন পত্রিকায় কাজ করেন। “অনলাইন পত্রিকায়“ সম্বাদিকতা করেন বলে জানালেন। ২/৩ লাইন বলার পর আর শুদ্ধ আসেনা। “সাংবাদিক” শব্দটাকে উচ্চারণ করেন “সম্বাদিক“ বলে 😁। আর সাংবাদিকতা সম্পর্কে যা বলছেন সব উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক এবং বালখিল্যতা। পরে বিশিষ্ট বীর পুঙ্গব সাংবাদিকের ফেইসবুক একাউন্টে গিয়ে দেখলাম অন্যের নিউজ শেয়ার করে ওয়াল ভরিয়ে ফেলেছেন। নিজের হ্যাডম নাই এক লাইন লেখার। মনে মনে বলি ”আপনারাই সাংবাদিকতার পো.....ঙ্গা মেরে দিয়েছেন ” 😁।
কালের বিবর্তনে সাংবাদিক হয়েছে সম্বাদিক, পরবর্তী যাত্রা সম্বাদিক থেকে হাম্বাদিক। জয় হোক হাম্বাদিকতার।
(চলবে)
বিঃ দ্রঃ নিজ দায়িত্বে পড়িবেন। কোনো বিষয় অযথা নিজের উপর টানিয়া লইয়া লেখককে দায়ী করা যাইবেনা।
মুরগির খোপ ছেড়েছি প্রায় বছর খানেক হলো। সেইসব বৈচিত্রময় দিনগুলো আজো আমার হৃদয় মানসপটে অম্লান। বঙ্গদেশ থেকে আগত মুরগিরা মুরগির খোপকে বৈচিত্রময় করে তুলেছেন তাদের চিন্তা এবং প্রাত্যহিক কর্ম দিয়ে।
সকালে মুরগিদের হাঁক ডাক আর শুনিনা, আকাশ-পাতাল সমতুল্য চাপাবাজি, নিত্য বিবি তালাকের ঝগড়া, মূর্খ আমিলিক-বিম্পির নেতাদের সস্তা গল্প, দ্বিতল খাটে শুয়ে প্রেমিকার কাছে ফরাসি দেশ কিনে ফেলার গল্প। একসময় এসব শুনে বিনোদিত হতাম।
চালন বাটি করা লাগবো
........................................
এইতো কিছুদিন আগে প্যারিসের বাঙালি পাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে‘র রাস্তা দিয়ে হাটছি। মাঝ বয়সী বাঙালি চাচা আমার সামনে দিয়ে দ্রুত হেটে যাচ্ছেন, এক হাতে বাজার সদাইয়ের ব্যাগ অন্য হাতে ফোনে কথা বলছেন। ফোনের অপর প্রান্তের লোকটির উপর চাচা খুব বিরক্ত। বুঝলাম বাসায় যাওয়ার খুব তাড়া, পারলে হাওয়াই জাহাজে চড়ে যেতে চান। কিন্তু কেন এতো তাড়া ?
কিছুটা বিরক্ত হয়েই চাচা ফোনে লোকটিকে বললেন
“হেটার ঘরর হেটা, খল দেয়ার আর টাইম পাইসসনা। ঘরো গিয়া চালন বাটি করতাম, বাদে মাতুমনে। “
বুঝতে আমার আর অসুবিধা হলোনা, চাচা একটি মুরগীর খোপের দায়িত্বে আছেন, মুরগীর খাদ্য বন্টনের মহান কর্মে নিয়োজিত। রাত ১০ টা বাজলে মুরগীরা খোপে ফিরতে শুরু করে। তার আগেই ছোট ছোট বাটিতে চালন (তরকারি) বন্টন শেষ করতে হবে। তরকারি সমভাবে বন্টন না হলে মুরগীদের মধ্যে কাজিয়া লাগার সম্ভাবনা আছে। এমনকি এ কাজিয়া রাতের ঘুম নষ্ট করে খুনোখুনি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। তবে মুরগী ব্যবসাtয়ীরা কাজিয়া বাড়তে দেননা।
মুরগির খোপে রাজনীতি
........................................
সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে গিয়ে বসতি গড়ে তোলে। সেইসাথে নিয়ে যায় নিজস্ব সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ।
বাঙালি পৃথিবীর যে দেশে গিয়েছে, সে দেশেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গিয়েছে। শুনেছি পরবর্তী টার্গেট নাকি চাঁন্দের দেশ। ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপানে আমিলিক-বিম্পির রাজনীতির পর এবারের টার্গেট নাকি উগান্ডা আর ঘানা !!!! তো মুরগির খোপ কেন রাজনীতির বাহিরে থাকবে। মুরগির খোপে আমার থাকার বন্দোবস্ত হবার পর বুঝলাম দুই ধরণের রাজনীতির চর্চা হয় এখানে। প্রথমত, মুরগির খোপের আধিপত্য এবং ঘুমের বেপারীকে তেল মারার রাজনীতি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ -বিএনপির রাজনীতি।
মুরগির খোপে গ্রূপিং থেকে রাজনীতির সূত্রপাত হয়। অনেক কারণে গ্রূপিং হয় যেমন আঞ্চলিকতা, আমিলিক-বিন্পি এবং কাগজধারী সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে মুরগি ব্যবসায়ীর কান ভারী করে। অমুকের তরকারি মজা হয়নি, একজনের চালন আরেকজন খেয়ে ফেলছে, টয়লেট ব্যবহার করে ফ্ল্যাশ করেনি, নাক ডাকা সহ এমন অভিযোগ এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায়ই করে। তবে ঘুমের বেপারী (মুরগি ব্যবসায়ী) এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ। ঘুমের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে নিরপেক্ষ থাকতেই হবে।
পুলিশে ধরবে
....................................
ফ্রান্সে বাঙালি সমাজে স্বদেশী কুতুবদের কাজকর্ম অত্যন্ত হাস্যকর। কুতুবদের কেউ কেউ নিজেকে আওয়ামীলীগের, কেউ বিএনপির, কেউ কমিউনিটি নেতা দাবি করে। কেউ মুরগী পালন করেন, অনেকে সাংবাদিক ( পড়ুন সাংঘাতিক) লালন পালন করে, আবার কেউ চামচা পোষে। একজন আরেকজনকে ভয় দেখিয়ে নিবৃত করে, অনৈতিক সুবিধা আদায় করে। মুরগীর খোপে পুরাতন মুরগীরা নতুন মুরগীকে ভয় দেখায়, নতুন কেউ আসলে সবাই মিলে মিশে ভয় দেখায়। এটা করবেননা, সেটা করবেননা, করলে পুলিশে ধরবে।
ফরাসি দেশে আসার আগেই আমি রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন এবং পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে আসি। কেনো এসব তথ্য আমি জানি, এ নিয়ে মুরগির খোপের আদি বাসিন্দাদের প্রবল ক্ষোভ !!! কেনো আমি তাদের কাছে তথ্য জানতে চাইনা !!!
নতুন মুরগীকে(মেস মেম্বার) দিয়ে রান্নার কাজ করানো প্যারিসের বাংলাদেশী মেস গুলোর অন্যতম বদঅভ্যাস। কিছুদিন আগে নোয়াখালীর একজনের সাথে কথা হলো এ বিষয়ে। ৬ বছর আগে তিনি ফ্রান্সে আসেন। এসেই তিনি মুরগির খোপে উঠেন, পুরাতন মুরগিরা তাকে ঘর থেকে বের হতে দিতোনা পুলিশের ভয় দেখিয়ে। অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে তিনি তাঁর মেসের মেম্বারদের সম্পর্কে বললেন “ মা******র হুতেরা আঁরে দি ৩ মাস ভাত রান্দাইছে” 😁 (অর্থাৎ মা******র পোলারা তাকে দিয়ে প্রতিদিন রান্না করিয়েছে।) মেসের কথা উঠলেই তিনি গালি দেন। মনে তার অনেক ক্ষোভ, ব্যথা। মুরগির খোপের মালিক এবং মুরগি ব্যবসার প্রতি তার আজন্ম ঘৃণা।
হারামি খোর
......................
ফরাসী দেশে বাঙালি সমাজে একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো ”হারামি খোর”😁 যারা সরকারি ভাতা খায় তাদেরকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সহজ বাংলায় এটা হলো “বেকার ভাতা“
অনেকে বছরের পর বছর বেকার ভাতা খেয়েই যাচ্ছে কাজ কর্ম ছাড়া। অনেকে আবার সরকারকে ট্যাক্স না দিয়েই নগদ বেতনে কাজ করছেন সাথে বেকার ভাতাও পাচ্ছেন। যারা “বেকার ভাতা“ পাননা অথবা ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন, তারাই মূলত “হারামি খোর“ বলে অভিহিত করেন। আবার ব্যক্তিগত রেষারেষির এবং প্রতিহিংসার কারণেও একজন আরেকজনকে ”হারামি খোর” বলেন। মুরগি খোপে এই বিষয়ে বহু বিতর্ক এবং ঝগড়া বিবাদ হতে দেখেছি। ২০১৬ সালের দিকে আমার দ্বিতীয় মুরগির খোপে এ নিয়ে বিশাল বিরোধের সূত্রপাত হয়েছিল। বিতর্ক সহিংসতায় রূপ নিলে, মধ্যরাতে আমাকে মধ্যস্থতা করে দুপক্ষকে শান্ত করতে হয়েছে।
টাহা দিয়া খাইতেয়াছি
..............................
খেলাধুলায়, ব্যবসায় কিংবা নির্বাচনে প্রতিযোগিতা আমরা প্রায়ই দেখি। এটা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফরাসি দেশে বাঙালি মুরগির খোপে খাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা আমাকে আশ্চর্য করেছে। কে কার চাইতে বেশি খাবে তা নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা !!!
৬ জনের মুরগির খোপে ৫ কেজি মাংস মুহূর্তেই নাই !!!
তাজ্জব হয়ে গেলাম 🙄 রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে “ডক ডক ডক“ করে গ্লাসে দুধ খাচ্ছে !!!
এরপর একজন আরেকজনকে দোষ দেয় “অমুকে বেশি খায়, তমুকে বেশি খায়” । মুরগিদের মনোভাব ”টাকা দিয়ে খাই, কম খামু কেনো” !!!!
প্রতিযোগিতা করে খাওয়া নিয়ে একদিন মুরগির খোপে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো। সকাল ৮ টা, গভীর নিদ্রা মগ্ন আমি। হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলো মুরগিদের হাঁকডাকে। কান খাড়া করে শুনলাম দুধ খাওয়া নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত। কেউ একজন দুধ বেশি খেয়েছে, সকালে অন্যদের জন্য নাই, তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। তিনজন মিলে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে “বেশি দুধ“ খায় বলে। তবে আমার মনে হলো “অভিযুক্ত ব্যক্তি“ রাজনীতি কিংবা ষড়যন্ত্রের শিকার। সাতসকালে আমি প্রস্তাব করলাম এ বিষয়ে রাতে রাতে বৈঠক হবে। অভিযোগকারী তিনজন এটি মেনে নিতে নারাজ, তাদের দাবি একটাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যেন মুরগির খোপ থেকে বের করে দেয়া হয়। অবশেষে রাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো ”নাস্তা” উঠিয়ে দেয়ার। পরে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম “মুই টাহা দিয়া খাইতেয়াছি, মাগনা খাই ?”
সম্বাদিক বনাম সাংবাদিক
........................................
প্যারিসে বাংলা সাংবাদিকতার সংজ্ঞা : মানুষের মুখের সামনে বুম/মাইক ধরে ভিডিও করাকে সাংবাদিকতা বলে। ধারণকৃত ছবি এবং ভিডিও পরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ”ইউরো ভর্তি খাম” নেয়াকেও সাংবাদিকতা বলে। 😁
চারিদিকে শুধু সম্বাদিক, কিন্তু সাংবাদিক দেখিনা। গত কয়েক বছরে ফ্রান্সে বাংলা সাংবাদিকতার বাম্পার ফলন হয়েছে। প্যারিসের অলিতে-গলিতে বাঙালি সম্বাদিক। সবাই শুধু সম্বাদিক হতে চায় !!! ফেইসবুক লাইভের সম্বাদিক, অনলাইন পোর্টালের সম্বাদিক, টেলিভিশন চ্যানেলের সম্বাদিক। সম্বাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে অনেকে গৌরব বোধ করেন।
অনেকের মতে প্যারিসে বাংলা “সাংবাদিকতা” একটি গালি। সাংবাদিকতার অপর নাম চ বর্গীয় গালি 😁
“সাংবাদিকতা”র পশ্চাৎদেশ মেরে দিয়েছেন এই বিশিষ্ট সম্বাদিকরা 😁। সেদিনই বুঝেছি সাংবাদিকতা ধর্ষিত হয়েছে, যেদিন ভাতের হোটেলের মালিক এবং মুদি দোকানদারকে বানিয়েছে অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক !!!
ফরাসি দেশে আসার পর কয়েকটি সভা-সেমিনারে গিয়ে “সম্বাদিক“ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।সভা শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ভিডিও/ছবি ধারণ করেন। দুই /তিনটা প্রোগ্রাম একসাথে থাকলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন এবং যাওয়ার সময় আয়োজকদের বলে যান “আচ্ছা ভাই দেখা হবে“😁 অর্থাৎ “টাকা ওয়ালা খাম“ সম্পর্কে কিছু বলেন 😁 আয়োজকরা চুপি চুপি একটা কোনায় গিয়ে “খাম“ হস্তান্তর করেন অথবা বলেন “আচ্ছা আমি বিকেলে দেখা করবো“ 😁😁😁
প্যারিসে সাংবাদিকতার (পড়ুন সম্বাদিকতা) ব্যবসা চলে মূলত টেলিভিশনে খোমা দেখানো নিয়ে। কমিউনিটি নেতা নামক বীর পুঙ্গব গুলো টেলিভিশনে খোমা দেখালেই খুশী 😁। টেলিভিশনে প্রবাসী নিউজে ২০ সেকেন্ড দেখালেই সফল। খুশীতে গদ গদ হয়ে সম্বাদিক নামের প্রাণী গুলোকে টাকা দেয়। দুই পক্ষই খুশী !!! পরেরদিন কমিউনিটি ন্যাতা-খ্যাতা গুলো নিজের ফেসবুকে ওই নিউজ শেয়ার করে। এতেই নিহিত সুখ। এটাই সমাজ সেবা !!! সম্বাদিক খুশী, নেতাও খুশী 😁
মাস ছয়েক আগে এমনি এক সম্বাদিকের সাথে দেখা হলো বাঙালিপাড়া খ্যাত গার দে নর্ডে। স্বল্প পরিচিত এক লোক পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশিষ্ট সম্বাদিকের সাথে !!!! জিজ্ঞেস করলাম কোন পত্রিকায় কাজ করেন। “অনলাইন পত্রিকায়“ সম্বাদিকতা করেন বলে জানালেন। ২/৩ লাইন বলার পর আর শুদ্ধ আসেনা। “সাংবাদিক” শব্দটাকে উচ্চারণ করেন “সম্বাদিক“ বলে 😁। আর সাংবাদিকতা সম্পর্কে যা বলছেন সব উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক এবং বালখিল্যতা। পরে বিশিষ্ট বীর পুঙ্গব সাংবাদিকের ফেইসবুক একাউন্টে গিয়ে দেখলাম অন্যের নিউজ শেয়ার করে ওয়াল ভরিয়ে ফেলেছেন। নিজের হ্যাডম নাই এক লাইন লেখার। মনে মনে বলি ”আপনারাই সাংবাদিকতার পো.....ঙ্গা মেরে দিয়েছেন ” 😁।
কালের বিবর্তনে সাংবাদিক হয়েছে সম্বাদিক, পরবর্তী যাত্রা সম্বাদিক থেকে হাম্বাদিক। জয় হোক হাম্বাদিকতার।
(চলবে)
বিঃ দ্রঃ নিজ দায়িত্বে পড়িবেন। কোনো বিষয় অযথা নিজের উপর টানিয়া লইয়া লেখককে দায়ী করা যাইবেনা।
No comments:
Post a Comment