Sunday, 22 October 2017

ঢাকা বি-মানবন্দর কবে এ-মানের হবে?

‘আজি হতে’ প্রায় চার দশক আগে, ১৯৮৩ সাল থেকে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছি। আশির দশকে আমার সদ্যতরুণ চোখে এই বিমানবন্দর ছবির মতো মনে হত। ছবিটি দিনে দিনে নষ্ট হয়েছে। গত পঁয়ত্রিশ বছরে ঢাকা বিমানবন্দরের ‘নাম’ পাল্টেছে দুইবার, কিন্তু যাত্রীসেবার ‘মান’ খুব একটা বাড়েনি। বিমানবন্দরের প্রায় সর্বত্র অসভ্যতা ও কুরুচির ছাপ। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বিনামেঘে অপমানের বজ্রপাত নেমে এসে আঘাত করে নাজেহাল যাত্রী ও তাদের সঙ্গীদের।
ঢাকা বিমানবন্দরে ঢোকার আগেই যাত্রীদের গাড়ি চেক করা হয়। প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একবার শুধু চোখ বুলিয়ে কী চেক হয় জানি না এবং দ্বিতীয়ত, এই অনর্থক ও অকার্যকর তল্লাসি বিদেশিদের মনে এই (ভুল?) ধারণা দিতে পারে যে, বাংলাদেশ একটি সদাশঙ্কিত পুলিশি রাষ্ট্র। যাত্রীর সঙ্গে আসা বাকি নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের অনেক সময় রাস্তার উপরই নামিয়ে দেওয়া হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো বিমানবন্দরে এমন অপমানজনক এবং নিষ্ঠুর ব্যবস্থা দেখিনি।
বিমান ভ্রমণের সঙ্গে অন্য সব ভ্রমণের তফাৎ আছে। সাধারণত অনেক দিনের জন্যে বিদায় বা অনেকদিন পরে আগমনের কারণে আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই বিমানবন্দরে (চট্টগ্রামের ভাষায়) ‘উজাইতে’ (অর্থাৎ ‘সি-অফ’ বা ‘রিসিভ’ করতে) আসে। পৃথিবীর বেশিরভাগ বিমানবন্দরে যাত্রী ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগ পর্যন্ত এই ‘উজানি’ অভ্যাগতদের খাদ্য ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে। এতে বিমানবন্দরের কিছু অর্থাগমও হয়। বাংলাদেশের বিমানবন্দরে যাত্রী ছাড়া বাকি লোকদের টিকেট কেটে বিমানবন্দরে ঢুকতে হয়। গরিব মানুষ টিকেট কেনার ঝামেলায় যায় না বা সেই সামর্থ্যও তাদের নেই। সুতরাং তারা এতিমের মতো ঘুরে ঘুরে বিমানবন্দরের গ্রিল কিংবা কাচের ফাঁক দিয়ে তাকাতে থাকে, যদি বাপ-ভাই-স্বামীকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখা যায়।
ঢাকা বিমানবন্দরের স্থাপত্যটাই যাত্রীবান্ধব নয়। বাঙালি চরিত্রের অপরিণামদর্শিতা বিমানবন্দরের স্থাপত্য ও ব্যবস্থাপনায় প্রকটভাবে দৃশ্যমান। সত্তর দশকের স্থপতিরা কল্পনাই করতে পারেননি যে, তিন বা চার দশক পর তাদের পরিকল্পিত বিমানবন্দরের কাজের চাপ কেমন হবে। কেন জানি না ঢাকা বিমানবন্দরে এসে নামতেই নিরাপত্তাহীনতা ভর করে মনে। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি কোনো বিপদ হল।
এর কারণও নিশ্চয়ই আছে। যেমন ধরা যাক, পৃথিবীর কোনো বিমানবন্দরের প্রবেশপথে পাসপোর্ট দেখাতে হয় না। দর্শনার্থী হিসেবে যারা ঢাকা বিমানবন্দরে ঢোকে তাদেরও কোনো প্রকার পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র দেখানোর প্রয়োজন নেই, গলায় বিমানবন্দর দর্শনের ইজারা নেওয়া কোম্পানির কার্ড ঝোলালেই চলে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে, ট্রলিতে লাগেজের পাহাড় নিয়ে যেসব যাত্রীরা ঢুকছেন, তাদের পাসপোর্ট দেখানো বাধ্যতামূলক। বিমানবন্দরে ঢোকার অনেকগুলো দরজা থাকলেও খোলা থাকে একটি কিংবা দুটি। কর্তৃপক্ষ সব ফ্লাইটের যাত্রীদের সেই দুই-একটি দরজা দিয়ে ঢুকতে বাধ্য করে। কোনো কারণে আপনার লেট হয়েছে কিনা, আপনার ফ্লাইট ধরার তাড়া আছে কি নেই, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। দুই হাতে ট্রলি ঠেলে নেবার সময় পাসপোর্ট দেখানো সহজ নয়। এত ঝামেলায় পাসপোর্ট বেহাত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
কিছুদিন আগে বিমানবন্দরে ঢোকার পথে পাসপোর্ট দেখানোর অযৌক্তিকতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সিকিউরিটি অফিসার ছুটে এসে বললেন, ‘এটা বিদেশ নয়। আপনার পছন্দ না হলে দেশ ছেড়ে চলে যান!’

Dhaka Airport - 6

ভাবা যায়? যাত্রীদের এরা কাগজের টিকেট দেখাতে বাধ্য করছে, অথচ পৃথিবীর সব বিমানবন্দরে মোবাইলে সেভ করা টিকেটের কপি দেখালেই চলে। ‘এটা বাংলাদেশ, এখানে কাগজ ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়’, গর্ব করে ঘোষণা দিলেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ অফিসার। পৃথিবীতে সম্ভবত সর্বোচ্চ ভ্রমণ-কর দিয়ে বিমানবন্দর ব্যবহার করতে যাই আমরা বাংলাদেশিরা। কোথায় সেবা পাব তা নয়, পরিবর্তে জুটছে অপমান।
অনেক দেশে, যেমন কানাডায়, দেশত্যাগের সময় ইমিগ্রেশনেও পাসপোর্ট দেখাতে হয় না। ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঢোকার সময়ও একই ঘটনা। তারা কীভাবে নিরাপত্তা রক্ষা করে কিংবা অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে? ইউরোপ বা আমেরিকার বেশিরভাগ বিমানবন্দরে আরোহণ বা অবতরণ কার্ড পূরণ করার ঝামেলা উঠে গেছে। এই সব কার্ডে লেখা বেশিরভাগ তথ্য তো পাসপোর্টেই লিপিবদ্ধ আছে। উন্নত দেশগুলোতে সব সময় এ ধরনের দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা কমানোর চেষ্টা থাকে। বাংলাদেশে সে সব যথাসম্ভব বাড়ানোর চেষ্টা থাকে। কারণ প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতাই হয় দুর্নীতি নয়তো ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করে।
আজ থেকে শখানেক বছর আগেও যে দেশ কোনো বিচারেই বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত ছিল না, সেই মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বিমানবন্দরের সহজ-সরল কিন্তু কেজো স্থাপত্য মনোমুগ্ধকর মনে হয়েছে আমার কাছে। কোথাও বাহুল্য নেই, অথচ স্থান-ব্যবস্থাপনা চমৎকার। অপসংস্কৃতি বা ছোটোলোকির এতটুকু ছাপ দেখলাম না কোথাও– কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, সিকিউকিরিটি তল্লাসি, কোথাও নয়।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের ঠিক মাঝখানে আছে একটি ‘বর্ষাবন’– ইংরেজিতে যাকে বলে রেইনফরেস্ট– মালয়েশিয়ার প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। সেখানে ঝর্ণা আছে, মেঠো পথ আছে, রয়েছে পাখির কলকাকলি। বর্ষাবনের আশেপাশে পরিপাটি করে সাজানো শদুয়েক দোকান। যেন বনের পাশে ছোট্ট সুন্দর একটি বাজার। দোকানগুলো পাশ্চাত্যের বিমানবন্দরে যেমনটি দেখা যায়, তার চেয়েও সুন্দরভাবে সাজানো। বিক্রেতাদের মুখে বিরক্তি নেই, মেকি হাসিও নেই। স্বাগতিক অকৃত্রিম হাসি দেখলাম তাদের চোখে। অর্থনীতিতে আমরা মালয়দের চাইতে পিছিয়ে আছি– রুচিতে এবং সেবাতেও তাদের চেয়ে এগোতে পারিনি। বর্তমান কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছে ঢাকা বিমানবন্দরের কমবেশি এক দশক পরে। যার অর্থ হচ্ছে, আজ থেকে তিন দশক আগেই মালয়েশিয়ার নেতৃবৃন্দ ও স্থপতিরা চিন্তা, কল্পনা ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে ছিলেন।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের টয়লেটে বেসিনের পাশে টবে তাজা ফুল বা নিদেনপক্ষে গুল্ম রাখা আছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দরে টয়লেটে প্রবেশপথে রাখা হয়েছে কুরুচির স্বাক্ষর প্লাস্টিকের গাছ। যেন বাংলাদেশে আসল গাছ, তাজা ফুল বা গুল্মের অভাব পড়েছে।
বিমানবন্দরের বাইরের টয়লেট তো কোনো ভদ্রলোকের ব্যবহার করার উপযুক্ত নয়, ভদ্রমহিলার কথা দূর অস্ত। গত তিন দশকে এই টয়লেট কোনো প্রকার সংস্কারের মুখ দেখেছে বলে মনে হয় না। তদুপরি এই নোংরা টয়লেট ব্যবহার করার বিনিময়ে টাকা (পায়খানা ৫, প্রশ্রাব ২ ইত্যাদি) নেবার জন্যে দুয়ার আগলে বসে আছে ক্রমাগত পশ্চাদ্দেশ চুলকাতে থাকা বা নাক খুঁটতে থাকা অপরিচ্ছন্ন কাপড় পরা এক বা একাধিক লোক। ভাংতি টাকা না থাকলে টয়লেট ব্যবহারের দুরাশা করবেন না। বিমানবন্দরের ভিতরের টয়লেট প্রায় কুড়ি বছর নোংরা থাকার পর গত এক বছরে কিছুটা উন্নত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ‘শুধু নিজের প্রয়োজনটুকু পূরণ করা এবং অন্যের কথা একেবারেই না ভাবার’ বদভ্যাসের কথা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষের উচিত মিনিট বিশেক পরপরই টয়লেট পরিষ্কার করার ব্যবস্থা রাখা।
যে বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আশির দশকে চালু হয়েছিল ঢাকা বিমানবন্দর, সেই বাংলাদেশ গত চার দশকে প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে ভীষণ রকম বদলে গেছে। স্থাপত্য ও স্থান-ব্যবস্থাপনার দিক থেকে দেখলে ‘আন্তর্জাতিক’ হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই এই ‘বুড়ি’ বিমানবন্দরের। বাংলাদেশের মতো একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ বা বাঙালির মতো একটি অভিবাসন-প্রবণ জাতির জন্যে যে ধরনের বিমানবন্দর অপরিহার্য, তার ধারেকাছেও নেই ঢাকা। বর্তমান বিমানবন্দরকে অভ্যন্তরীন বিমান-চলাচলের জন্যে ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বা ঢাকার অদূরে নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।

Dhaka Airport - 333

স্থাপত্যের দিক থেকে কেমন হওয়া উচিত সেই নতুন বিমানবন্দর? ঢাকা শহরের বিশ্রি সব ভাষ্কর্য ও স্থাপত্য দেখে দেখে বিরক্ত মন শান্ত হয়েছিল কিছুদিন আগে, আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর দেখে। স্বপ্ন দেখি, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অনুরূপ প্রতিভাবান কোনো স্থপতি বা স্থপতি গোষ্ঠী ঢাকার নতুন বিমানবন্দরের পরিকল্পনা করবেন। যাতে সৌন্দর্য ও প্রয়োজনের সুষম সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হবে। বস্তু ও আয়তনের সুষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়, তবে বস্তু অপেক্ষা আয়তন তিন বা চারগুণ বেশি হলে ভালো হয়।
বিমানবন্দরে প্রাকৃতিক আলো ও বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা থাকবে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের মতো মেঝেটা এমন হবে, যাতে হাঁটতে পায়ের আরাম হয়। অবশ্যই মেট্রো ও অন্যান্য দ্রুতযানে মূল শহরের সঙ্গে বিমানবন্দরের যোগাযোগ থাকতে হবে। খুব বেশি গাড়ি যেন সেখানে প্রবেশ করতে না হয়। নতুন বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে চক্রাকার (এই আধুনিকতম প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে হল্যান্ডে)। হিথ্রো বিমানবন্দরের ৫ নং টার্মিনালের অনুরূপ লাগেজ-ব্যবস্থাপনা থাকলে ভালো হয়। 
নতুন বিমানবন্দরের টার্মিনাল শুধু সুন্দর ও ব্যবহার-উপযোগী হবে না, একই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিও ধারণ করবে। সেখানে পুকুরসহ বাংলাদেশের একটি গ্রাম থাকতে পারে। সঙ্গে একটি বাজার। গ্রামের বাড়িগুলো হবে মাছ-ভাত-ডাল-ভর্তাসহ সুস্বাদু বাঙালি খাবারের এক একটি রেস্টুরেন্ট। বাজারে থাকবে দেশি পণ্যের দোকান (এখন যে দোকান আছে সেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়)। বিমানবন্দরে পরবর্তী ফ্লাইট ধরার জন্যে অপেক্ষমান যাত্রীরা পুকুরের পাড়ে দুদণ্ড বসে দেশি মাছ-হাঁস-বক দেখবে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার বা নিদেনপক্ষে মাছ ধরতে দেখার ব্যবস্থা থাকলেই-বা ক্ষতি কী?
এভাবে বিমানবন্দরেই বিদেশিরা আমাদের সুন্দর দেশ সম্পর্কে কমবেশি একটি ধারণা পেয়ে যাবে। বিমানবন্দরে সুভেনির ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার একাধিক ভালো দোকান থাকতেই হবে। যাতে যাত্রীরা প্রকৃত কেনাকাটা এবং দৃষ্টিলেহন (উউন্ডো শপিং) করে সময় কাটাতে পারে।
যেসব যাত্রী সাত/আট ঘণ্টার মতো বিমানবন্দরে অবস্থান করে বিশেষত তাদের কথা ভেবে যেসব সেবা বিমানবন্দরে রাখা যেতে পারে: বিনামূল্যে শক্তিশালী ওয়াইফাই, চুলকাটার ব্যবস্থা, (বিভিন্ন ধরনের) স্নান, কয়েক ঘণ্টা ঘুমানো বা বিশ্রাম নেবার জায়গা, শিশুদের খেলার জায়গা, ব্যায়ামাগার, মাসাজ-পার্লার, পাঠক সমাবেশ, বাতিঘর বা দীপনপুরের মতো লাইব্রেরি কাম বুকশপ, থিয়েটার-সিনেমা হল (কোরিয়ার কোনো কোনো বিমানবন্দরে যেমন আছে), শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা ইত্যাদি। বিমানবন্দরে লাগেজ রেখে কোনো যাত্রী কেন ঢাকা শহর দেখতে যেতে পারবে না? এই ব্যবস্থা কি বর্তমান বিমানবন্দরে আছে?
মনে রাখতে হবে, বিমানবন্দর একটি দেশের ড্রয়িংরুমের মতো। এটা সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে হবে। অতিথি যেই হোক না কেন, আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না থাকে। এমন কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যেন সেখানে না থাকে যার বিরুদ্ধে অসভ্যতা, নোংরামি বা অভদ্রতার একটি অভিযোগও পাওয়া গেছে। স্বপ্ন দেখি, নতুন বিমানবন্দরে ভয়ের নয়, নিরাপত্তার ও আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করবে।
বাংলাদেশের সিংহভাগ বিমানযাত্রী গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল লোক এবং অধিকাংশই প্রায় অশিক্ষিত। অনেকেই হয়তো প্রথমবারের মতো বিদেশ যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, এরাই বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতি সচল রেখেছে। এদের ঘামঝরা দিনার-রিয়ালের বদৌলতে আমরা নাগরিক বাঙালিদের যত নর্তন-কুর্দন। অথচ বিমানবন্দরের পরিবেশ এমন করে রাখা হয়েছে যে, এই যাত্রীরা অত্যন্ত অসহায় বোধ করেন। লক্ষ্য করেছি, এয়ারলাইন্সের কর্মচারীরা গরু-ছাগলের মতো ব্যবহার করে এই বিশেষ যাত্রীগোষ্ঠীর সঙ্গে। ফর্ম পূরণ ইত্যাদি কাজে সহায়তা করা, যাত্রীদের অসহায়ত্ব দূর করার জন্যে বিমানবন্দরে লোক থাকা দরকার। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ছাত্র বা স্কাউটদের পার্টটাইম এই কাজে লাগালে কেমন হয়?
নতুন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিছক পাসপোর্ট দেখানোর উপর নির্ভর করবে না। যাত্রীর গায়ে হাত না দিয়েই নিরাপত্তা ঝুঁকি দূর করতে জানবে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। লাইনে যেন দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না হয় কোনো যাত্রীকে। ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মকর্তারা যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করবে যাত্রীদের সঙ্গে– এই সত্যটা স্মরণে রেখে যে যাত্রীরাই মূলত তাদের অন্নদাতা। আমলা, শিক্ষক, সেনা, বিচারক সবাই আমরা জনগণকে সার্ভিস বা সেবা দিচ্ছি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, সোজা বাংলায় যার আক্ষরিক অর্থ: ‘জনগণের চাকর’। ‘চাকর’ যদি অভদ্র ব্যবহার করে তবে ‘মালিক’ জনগণ কেন তা মেনে নেবে?
সাধারণ ও গরিব জনগণের সঙ্গে সুব্যবহার এবং ভদ্রতার প্রসঙ্গটার পুনরাবৃত্তি করছি ইচ্ছে করেই। কারণ ভালো ব্যবহারে নিজের বংশের তো বটেই, জাতিরও পরিচয়। ব্যবহার খারাপ হলে ‘সকলি গরল ভেল’, অর্থাৎ বিমান বন্দরে অন্য হাজার সুবিধা দিয়েও কাজ হবে না।
স্বীকার করতেই হবে যে, ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা আগের তুলনায় বেড়েছে। এখানে ওখানে ফোন রাখা আছে। যাতে যাত্রীরা প্রয়োজনে নিখরচায় অভ্যর্থনাকারী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। ডিউটি ফ্রি শপে এক সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে বিক্রেতার ঘুম ভাঙাতে হত। দোকানদার মহোদয় কোনোমতে লুঙ্গির গিঁট মেরে লোমশ নাভি চুলকাতে চুলকাতে এসে রাগতঃস্বরে জিগ্যেস করত, ‘কী চাই’!
এখন অবস্থা দেখলাম আগের তুলনায় অনেক ভালো। স্মার্ট দোকানদার, ততোধিক স্মার্ট তার সহকারী।

Dhaka Airport - 444

একদিন সকালে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারদের চৌকশ ব্যবহার লক্ষ্য করেছিলাম বটে। এক ভারতীয় যাত্রী এসে হিন্দি ভাষায় অবতরণ ফর্ম চাইল। এক ইমিগ্রেশন(পুলিশ) অফিসার বুঝলেন না বলে পাশের অফিসার তার হিন্দি না-জানা নিয়ে কিঞ্চিৎ অনুযোগ করলেন। একটু পরে এক চীনা যাত্রীকে দেখে সেই হিন্দি না-বোঝা অফিসারটি বললেন, ‘নি হাঁও’, অর্থাৎ ‘কেমন আছেন?’ 
চীনা যাত্রীটি শুনে আপ্লুত। এমন অফিসারই তো চাই!
কিন্তু বিমানবন্দর পুলিশের পোশাকটাই তো আনস্মার্ট। এমন বিশ্রি রঙ ও কাপড় কে যে পছন্দ করেছিল! এই নিম্নমানের সিনথেটিক কাপড় অনেকক্ষণ পড়ে থাকলে গায়ে চুলকানি হয়ে যাওয়ার কথা। ‘বাঘে ছুলে আঠার ঘা’ কেন হয় তা জানি না, তবে ‘পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ হওয়ার কথা যে শোনা যায়, সেটা এই অস্বাস্থ্যকর পোষাকের কারণে নয়তো?
পুলিশ বা সেনা অফিসারের কাঁধের তকমাগুলো হতে হবে চকচকে পিতলের বা ইস্পাতের। যাতে ঠিকরে পড়া আলো দেখে অপরাধীর পিলে চমকে যায়। এখন সুতায় তৈরি অ্যামব্রয়ডারি করা তকমাগুলো পুলিশের পোশাকের মতোই ম্যাড়ম্যাড়ে। পুলিশের পোশাক উন্নত ও দৃষ্টিসুখকর করার বিকল্প নেই।
লাগেজ পেতে বেশি সময় লাগে যেসব বিমানবন্দরে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত যাত্রীদের লাগেজের জন্যে কেন হত্যে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? নতুন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীর মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ চলে আসবে ঠিক কোন জায়গায় তার লাগেজগুলো রাখা আছে সে বিষয়ে। বিমানবন্দরের সাফাইকর্মীরা বা হুইল চেয়ারের সঙ্গে থাকা বিমানবন্দরের পরিচারকেরা কেন সুবেশ স্মার্ট হবে না? কেন তারা পরিশ্রান্ত, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ যাত্রীদের কানের কাছে টাকা-ইউরো-ডলার চেয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করবে?
লাগেজ বহনের রঙচটা ট্রলিগুলো অবিলম্বে বদলাতে হবে। দেশের মানসম্মানের প্রশ্ন। বিমানবন্দরে আগমনস্থলে কমপক্ষে দশটা মানি এক্সচেঞ্জ আছে। পৃথিবীর যে কোনো বিমানবন্দরে থাকে দুয়েকটা। এত মানি এক্সচেঞ্জ কেন এবং অন্য কোনো দোকান কেন নেই? এর শানে নজুল কি এটা নয় যে, বাংলাদেশে ‘টঙ্কাহি কেবলম্’ অর্থাৎ ‘টাকাই সব কিছ’?
ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়ালগুলো রড-সিমেন্ট আর ফোন কোম্পানির রুচিহীন বিজ্ঞাপনে সয়লাব। বিশ্বকে বাংলাদেশের আর কিছুই কি দেওয়ার বা দেখাবার নেই? এক জায়গায় দেখলাম, অনেক বেওয়ারিশ লাগেজ পড়ে আছে। আর্দ্রতাদুষ্ট হয়ে কয়েকটি দেয়ালের রঙ চটে আছে। দেখে চটে যাবে যে কোনো রুচিবান, মননশীল মানুষ।
নটে গাছটি মুড়োয়নি এবং আমার কথাটিও এখনও ফুরোয়নি। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই বিদেশি বা বহুদিন পরে বিদেশ-প্রত্যাগত যাত্রী বাইরে তাকিয়ে দেখে, নটে গাছ নয়, দুই পাশে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে লাগানো অদ্ভূতদর্শন খটমটে (‘মেড ইন চাই না’) বনসাইয়ের (যেন বাংলাদেশে গাছের আকাল পড়েছিল) সারি। মাঝখানের রাস্তায় ছুটে চলেছে ঘেয়ো কুকুরের মতো দেখতে মান্ধাতার বাবার আমলের রঙচটা লক্কর-ঝক্কর বাস। যাতে উপচে পড়ছে অসহায় নাগরিক। হায়, আমাদের নেতৃবৃন্দ বা নগরপিতারা কি জানেন, রোজপাউডার লাগিয়ে মুখের অপুষ্টি ঢাকার বৃথা চেষ্টা হচ্ছে অনুন্নয়নের অন্যতম লক্ষণ?
পৃথিবীতে বাংলাদেশ হচ্ছে সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে বেশিরভাগ ট্রাক দেখতে বাসের চেয়ে সুন্দর। বাস কোম্পানিগুলোর অসৎ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি সবগুলো সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দূরে থাক, দৃষ্টিনন্দন এবং আরামদায়ক বাসের ব্যবস্থা করতেও সক্ষম হয়নি স্বাধীনতার পর গত হওয়া প্রায় পঞ্চাশ বছরে। মেট্রো হলে এসব সমস্যা অনেকখানি মিটবে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু মেট্রো হওয়া দূরে থাক, মেট্রোর কাজ ঠিকঠাকমতো শুরু হবারই-বা আর ‘কত দেরি, পাঞ্জেরী?’
রুচি ও অপরিণামদর্শিতার খরার অবসান হয়ে জানি না কবে আমাদের জীবনে ও মননে সুরুচি ও দূরদর্শী পরিকল্পনার বৃষ্টি নামবে। বর্ষা অবশ্য ইতোমধ্যে শেষ। তবে ভরসা এই যে, সামনে আরও অগুনতি বর্ষাকাল আছে।
আশা করি, ঢাকা B-মানবন্দর আমাদের জীবৎকালেই A-মানের হবে।
শিশির ভট্টাচার্য্যঅধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment