Tuesday, 6 July 2010

ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ : কিছু নতুন কথা

আজকাল “সন্ত্রাসবাদ”—শব্দটির সাথে দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও পরিচিত । আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল থেকে শুরু করে আমাদের পাড়ার কেল্টোর চায়ের দোকানের বৈঠকি আড্ডা সর্বত্রই শুনতে পাই । সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ তো প্রাতঃকর্মের মতো রোজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । আজ এখানে বিস্ফোরণে এতজন মরেছে তো কাল ওখানে আত্মঘাতী হানায় এতজন । শুনতে পাই ঠিকই , কিন্তু বিশ্বজুড়ে এর কোনও সমাধান না থাকায় ব্যাপারটা গা’সওয়া করে নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায়ও নেই ।
সন্ত্রাসবাদ শব্দ টির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল “terrorism”। অক্সফোর্ড ডিকশনারি তে ‘terrorism’ এর অর্থ করা হয়েছে— ‘the use of violent action in order to achieve political aims or to force a government to act’। অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন বা সরকার কে কাজ করার জন্য হিংসাত্মক কাজের দ্বারা বলপ্রয়োগ করা । আভিধানিক ভাবে বিচার করলে বলা যায় , যে উদ্দেশ্য তারা পূরণ করতে চায় সেটির জন্য হিংসাত্মক কাজের দ্বারা সরকার ও জনগণের মধ্যে তারা ভয় বা ত্রাসের সৃষ্টি কে তারা উপায় হিসাবে গ্রহন করে । কিন্তু উদ্দেশ্যটি সৎ না অসৎ, তা পরিষ্কার নয় । অর্থাৎ, উভয়ই হতে পারে ।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় , সন্ত্রাসবাদের আভিধানিক অর্থ মেনে নিলে, পৃথিবীর অনেক মহান বিপ্লবীকেও সন্ত্রাসবাদী বলতে হয় । কেননা তারাও সরকার পরিবর্তনের জন্য হিংসার আশ্রয় নিতেন । কিন্তু বর্তমান কালে সন্ত্রাসবাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত আলাদা । মানুষ সন্ত্রাসবাদী ও বিপ্লবী দের প্রতি সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে । তাদের এক ক্যাটাগরি তে ফেলতে চায় না । তারা জানে যে সন্ত্রাসবাদ অসৎ উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয় । সমাজ দার্শনিক গন মনে করেন , বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী দের মূল পার্থক্য হল –একজন ন্যায়ের জন্য অস্ত্র ধারণ করে অন্যজন অন্যায় দাবী আদায়ের জন্য অস্ত্র ধারণ করে । বিপ্লবীরা কখনোই নির্দোষ মানুষকে হত্যা করতে চান না । কিন্তু সন্ত্রাসবাদীরা নির্দোষ মানুষকে হত্যা করেই কাজ হাসিল করতে চায় । কমরেড মুজফফর আহমেদ তাঁর ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ গ্রন্থে বিপ্লবী কাজকর্মের বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ও সুস্পষ্ট ভাবে দেখিয়েছেন । তিনি বলেছেন , “ যারা কোনও শোষিত শ্রেণীর পক্ষ থেকে পুরনো শোষক সমাজ কে ভেঙ্গে দিয়ে তাঁর জায়গায় সুন্দরতর , উন্নততর ও জটিলতর সমাজের প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করেন তারাই বিপ্লবী। এই বিপ্লবের দ্বারা স্থাপিত সমাজে জনগণ ক্ষমতার অধিকারী হবেন । অতএব শোষণ থাকবে না । সামাজিক পরিবর্তন কিছু হল না অথচ কিছু সংখ্যক লোকের জায়গায় অন্য কিছু সংখ্যক লোক এসে বসলো , এটা বিপ্লব নয়।” অর্থাৎ, বিপ্লবী দের মধ্যে থাকে বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের আদর্শ,আর সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে থাকে অন্ধবিশ্বাস । তাই ইউনাইটেড নেশনস ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত্রাসবাদের এর একটি সংজ্ঞা প্রদান করে , তাতে বলা হয় –“ যে কাজ সাধারণ ও অসামরিক নাগরিক দের মৃত্যু ঘটানোর জন্য বা গুরুতর ভাবে আহত করার জন্য ব্যবহার করা হয় , তাই সন্ত্রাসবাদ । এর উদ্দেশ্য হল কোনও একটি জনগোষ্ঠী কে বা সরকার কে বা কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা কে কিছু করতে বাধ্য করা বা কিছু করা থেকে বিরত হতে বাধ্য করা ।”
তবে এই আপাত সংজ্ঞায় যাই বলা হোক না কেন, সন্ত্রাসবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা এখনও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি । কেন না , সন্ত্রাসবাদ শব্দ টি বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা পেয়েছে । শুধু তাই নয় । রোজদিন সন্ত্রাসবাদের নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েই চলেছে । সাইবার সন্ত্রাস,যৌন সন্ত্রাস ইত্যাদির মতো নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি আরও বেশি জটিল হয়ে উঠছে । ফলে হয়তো ভবিষ্যতেও এর সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় সম্ভব হবে না ।
এতে যে বিশেষ কোনও অসুবিধার সৃষ্টি হয় বা হবে, তাও কিন্তু না । কারণ আমরা সকলেই সন্ত্রাসবাদ শব্দটির বহুমাত্রিকতা কে জানি। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর অর্থ নির্ণয়েও আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কোনও সমস্যা হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে সন্ত্রাসবাদের বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে —
১) সন্ত্রাসবাদ সাধারণ মানুষ ও সরকারের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ।
২) আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয় হিংসাত্মক বা নাশকতা মূলক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা ।
৩) আতঙ্ক বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয় কোন সু সংগঠিত দল বা জনগোষ্ঠী দ্বারা ।
৪) আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা সেই জনগোষ্ঠী কে বা সরকার কে কোনও কাজ করতে বা কোনও কাজ না করতে বাধ্য করে বা বাধ্য করার চেষ্টা করে ।
৫) তাদের কার্যকলাপের মূলে থাকে অন্ধবিশ্বাস । এই অন্ধবিশ্বাস যে, একমাত্র তাদের পথেই মানুষের তথা সমাজের মঙ্গল সম্ভব।
৬) তাদের অন্ধবিশ্বাসের বাস্তব রূপদানের জন্য তারা সব কিছু করতে পারে। এমন কি নিজেদের মৃত্যু ঘটাতেও এরা পিছপা হয় না ।
সন্ত্রাসবাদ অনেক প্রকারের হতে পারে । তবে মুলতঃ সন্ত্রাসবাদ কে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে ।
ক) রাজনৈতিক
খ) সামাজিক
গ) ধর্মীয় ও
ঘ) মনস্তাত্ত্বিক ।
তবে বর্তমান সময়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদই সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে পরিচিত ও আলোচিত রূপ ।
এখন প্রশ্ন, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ কি ? উত্তর হল , ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বলতে আমরা সেই সন্ত্রাসবাদ কে বুঝি ,যে সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ধর্মীয় । অর্থাৎ ধর্মীয় উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় চরিতার্থ করার জন্য হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো এবং সাধারণ নাগরিক ও সরকারের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা । কিন্তু সমস্ত ধর্মপ্রভাবিত সন্ত্রাসবাদকেই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বলা যায় না। যেমন শিখ সন্ত্রাসবাদের মধ্যে ধর্মের প্রচুর প্রভাব থাকলেও তাকে জাতিসত্তার সন্ত্রাসবাদ বলেই মনে করা হয় । আসলে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ শব্দটি ব্যাবহার হতে শুরু করেছে ও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা কৃত সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে । এদের উদ্দেশ্য হল ইসলাম ধর্মকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করা, যা ‘pan Islamism’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। তবে তারাও জানে যে ইসলাম কে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। কেননা, পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম একরকম নয় । ইন্দোনেশিয়া , বাংলাদেশ ,ইরান ও সৌদি আরব—এদের প্রত্যেকের ইসলাম আলাদা । এদের একটি রাষ্ট্রে বা বিশ্বরাষ্ট্রে এদের একত্রীকরণ করা হলেও এরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কেননা, সংস্কৃতি গত দিক থেকে এদের মধ্যে বিস্তর ফারাক । তাই তাদের উদ্দেশ্য ইসলামের বদলে শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করা । তাই ভিতরে ভিতরে সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্রের (যেমন- মালয়েশিয়া , ইন্দোনেশিয়া) শরিয়াকরন করে সকলকে এক ছাতার তলায় আনতে চায় ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমানে বিশ্ব বিজ্ঞানে এত উন্নতি করেছে যে বিজ্ঞান ছাড়া মানুষের এক পা ও চলা সম্ভব নয় । তবু অপ্রত্যাশিত ভাবে তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ । কিন্তু কেন ? উত্তরে মোটামুটি ভাবে বলা যায় যে , প্রশ্ন টির মধ্যেই উত্তর টি নিহিত । বর্তমান বিশ্ব এমনই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে যে কালকের মনন,মানসিকতা আজ পালটে যাচ্ছে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত উন্নত হচ্ছে যে এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না সহস্রাব্দ কাল প্রাচীন অ-পরিবর্তনযোগ্য ধর্ম গুলো । একই ভাবে ডারউইনীয় নীতি মেনে কিছু মানুষও তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। তারা আশ্রয় নিচ্ছে তাদেরই মতো পিছিয়ে পড়ে থাকা ধর্মের কোলে । তারা বুঝতে পারছে যে , এটাই তাদের শেষ আশ্রয় । তাই তারা এটাকে আঁকড়ে ধরে আছে । এই আশ্রয়টাকে তারা হারাতে চায় না । বাঁচিয়ে রাখতে চায় যে কোনও মূল্যে । যখন যুক্তি, নীতি ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ে তারা হেরে যায় , তখন তারা সম্বল করে সেই সহস্রাব্দ প্রাচীন হিংসা কে । প্রাচীনকালের হিংসা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মোড়কে ঢেলে আতঙ্ক তৈরি করে সেইসব সাধারণ মানুষের মনে, যারা খাওয়া-পড়া-বাঁচা-বাড়ার জীবনসংগ্রামের বাইরে আর কিছুই বিচার্যের মধ্যে ফেলে না । উদ্দেশ্য একটাই — এখনকার সমাজকে আগেকার ধর্মীয় সমাজের রূপদান করা । নিজে এগিয়ে যেতে না পেরে এরা চায় সমাজকেই পিছিয়ে দিতে । এবং সমাজের একটা অংশের অকুণ্ঠ সমর্থনও পায় এরা । এখন আমরা সমাজের এই বিশেষ অংশের আপাত নিরীহ মানুষদের নিয়ে আলোচনা করবো, যারা হিংসক সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করে । আলোচনা করবো,তারা কিভাবে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করে ও কিভাবে সন্ত্রাসী দের উদ্দেশ্যের বাস্তব রূপদানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে —
আমরা আমাদের আসেপাসে চিরপরিচিত অনেক মানুষ দেখি যারা ধর্ম নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে । সুযোগ পেলেই যে কোনও বিষয়ে আমাদের একটু ধর্মীয় জ্ঞান দিতে চায় , সুযোগ পেলেই কোরআন হাদিসের বাণী শোনায় । যে কোনও সমস্যার প্রকৃত ইসলামী সমাধান টি আমাদের আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এরা সর্বত্র মানুষকে ভালো মুসলিম হওয়ার পরামর্শ দেয় । পরিবারে যদি কেউ ধর্মের প্রতি গুরুত্ব না দেয় , তাদের দেখতে পারে না । তাদেরকে যথা সম্ভব অন্যদের চোখে খারাপ করে দিতে চায় । কথায় কথায় কোরআন হাদিস আওড়ায় । উদ্দেশ্য, অন্যের মনে সর্বক্ষণের জন্য আল্লাহ-র ভয় স্থাপন করে দেওয়া । সাধারণ মানুষ কে সর্বত্র আল্লাহ-র ভয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখা। নিজের স্ত্রী সন্তানই হয় এদের প্রথম শিকার । কেননা , তারাই এদের সবচেয়ে কাছে থাকে। সর্বদা শোনে নামাজ আদায় না করলে এই হবে, রোজ কোরআন না পাঠ করলে ওই হবে। বার বার শুনতে শুনতে তারা বিশ্বাস ও করতে শুরু করে। আর স্ত্রী বিশ্বাস না করলে তাকে অবাধ্যতা ভেবে নিয়ে কোরআনে বৈধ স্ত্রী প্রহারের আয়াত কার্যকরী করেন , তালাকের ও ভয় দেখান । সন্তান রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় না করলে কত বছর বয়সে কি কি শাস্তির বিধান আছে , সেই অনুযায়ী প্রথমে হুমকি দেন । তার পর সন্তানকেও পেটান । এসব ইসলামী সমাজে চলে আসছে দিনের পর দিন । এমন কি বুজুর্গ দেরও অধার্মিকতা দেখলে তাদের ভর্তসনা করতেও ছাড়েন না। এরা স্কুল কলেজ অফিস আদালতে কর্মরত থাকলেও সর্বত্রই নিজেদের সত্যিকার ধার্মিক হিসাবে দেখেন ও দেখাতে চান । অন্য ধর্মের লোক দের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না । কিন্তু কেউ অন্য ধর্ম সম্প্রদায় ভুক্ত দের খারাপ প্রতিপন্ন করতে চাইলে তাদের বিরোধিতা তো করেন ই না । উল্টে তাদের কথায় ছোট ছোট বুদ্ধিদীপ্ত সমর্থন নীতিবাক্য আওড়ে তাদের উস্কানি দেন । তাদের প্রশংসা করেন বলেন, কোরআনে তো এমনই বলা আছে । পাড়ার চায়ের দোকানে থেকে শুরু করে ধর্মীয় জলসায় লাদেন , মোল্লা ওমর দের প্রসঙ্গ উঠলে তারা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বিজ্ঞের মতো সন্ত্রাসবাদের উৎস সন্ধানে লেগে পড়েন । তাতে আমেরিকার দোষ খোঁজেন, ইসলামের অস্তিত্বের সঙ্কটের জন্য পাশ্চাত্যকে দায়ী করেন । কিন্তু কখনোই তাদের দোষারোপ করেন না । সরাসরি প্রশ্ন করা হলে অস্বস্তি ভরে এড়িয়ে যান । কিন্তু সন্ত্রাসবাদী দের কর্মকাণ্ডের খবরে মুসলিম হিসাবে গর্বে বুক ভরে ওঠে ।
এরকম মানুষ আমরা সকলেই দেখেছি। এরা আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ । কোনভাবেই এদের ক্রিমিনাল মনে করা যায় না । এদের আমরা ‘একটু বেশিই ধার্মিক’ ভেবে থাকি এবং এরা সর্বত্রই একটু বেশি সমীহ পেয়ে থাকেন । অন্যকে ধার্মিক বানাতে এরা থাকে সদা তৎপর । এদের ক্রিয়াকলাপ কে আমরা কখনোই সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়া হিসাবে দেখি না । কিন্তু একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে, বিষয়টি টি আপাত ভাবে দেখলে সন্ত্রাসবাদ থেকে আলাদা মনে হয় । কিন্তু মোটেও আলাদা নয় । বরং বলা যায় একেবারে ‘আণবিক স্তরের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ’ । হয়তো বলবেন ,আমিই বাড়াবাড়ি করছি । কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন । আচ্ছা আমিই বোঝানোর চেষ্টা করছি —
আমরা যারা সমাজবিজ্ঞান বা সমাজদর্শনের ছাত্রছাত্রী তারা সকলেই জানি যে, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । এবং সেই হিসাবে অনেকে একসাথে কাজ করি বা কাজ করতে বাধ্য হই। একে যৌথ কার্য ( corporate action) বলে । যৌথ কার্য এর ফলেই সমাজ তার রূপ পায় । সমাজ বলতে আমরা বুঝি মূলত ছয় প্রকার প্রতিষ্ঠান (institution) —
১) পরিবার , যেখানে শিশু জন্মলাভ করে তার সভ্যভুক্ত হয় ও যত্ন সহকারে প্রতিপালিত হয় ।
২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , যার সভ্যভুক্ত হয়ে সে জীবনের জন্য প্রস্তুত হয় ও যথাযথ শিক্ষা লাভ করে ।
৩) কর্ম প্রতিষ্ঠান , যার সভ্যভুক্ত হয়ে সে কর্ম করে ও জীবিকা অর্জন করে ।
৪) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান , যার সভ্যভুক্ত হয় সে জন্ম থেকেই ,এবং যার অধীনে ও পরিচালনায় সে নিজের জীবনকালে সমস্ত কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করে ।
৫) সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান , যার সভ্যভুক্ত হয়ে সে নিজের জীবন কে সুন্দর ও মহৎ করতে চেষ্টা করে ।
৬) ধর্ম প্রতিষ্ঠান , যার সভ্যভুক্ত হয়ে সে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে ।
প্রতি টি প্রতিষ্ঠানে মানুষ যৌথ ভাবে ক্রিয়া করে । একক ভাবে নয় । যৌথ কার্য সৃষ্টি করে সাধারণের ইচ্ছা (general will) এর । এই সাধারণের ইচ্ছাই সকল প্রতিষ্ঠানের চালিকা শক্তি ।
আমি চাই ঠিক এইজায়গায় , অর্থাৎ একেবারে মূলে এসে সন্ত্রাসকে অনুসন্ধান করতে । আমার মতে, আতঙ্ক বা ত্রাস দুই ভাবে তৈরি করা যেতে পারে –
১)কোনও প্রতিষ্ঠানে এই সাধারণের ইচ্ছা কে গুরুত্ব না দিয়ে যদি বিশেষ কারো ইচ্ছা কে বাস্তবায়িত করার জন্য বলপ্রয়োগ করলে ।
২) একটি প্রতিষ্ঠানের বাঁধাধরা রীতি নীতি অন্য প্রতিষ্ঠান গুলিতেও বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য বলপ্রয়োগ করলে ।
রাষ্ট্রই একমাত্র ইন্সটিটিউশন নয় । পরিবার , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , কর্ম প্রতিষ্ঠান –সবগুলিই ইন্সটিটিউশন । সুতরাং রাষ্ট্রের মতো এই সব প্রতিষ্ঠানেও আতঙ্ক তৈরি করা যেতে পারে । এবং এই বলপ্রয়োগকারীই হল সন্ত্রাসবাদী । কেউ ভাবতে পারেন, “তাহলে তো পরিবারের মধ্যে পিতা যদি সন্তানকে কোনও খারাপ কাজ করতে বাধা দেওয়ার জন্য বকে বা মেরে তার মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করেন, তাকে কি সন্ত্রাস বলা যায় ?” উত্তর হবে, “না” । কেননা ,পরিবারের ‘সাধারণ ইচ্ছা’ এই থাকে যে, সন্তানটি বড় হয়ে সুনাগরিক হয়ে উঠুক এবং পরিবারের সম্মান বজায় রাখুক । সেক্ষেত্রে একে কার্যকর করে পিতা , এটি সাধারণের ইচ্ছার ই প্রকাশ ।
এখন প্রশ্ন, তাহলে কিভাবে চিনবো যে কারা আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদী ? প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ । তাই আমরা এখন আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদী দের বৈশিষ্ট্য গুলি জেনে নেবো । অন্যান্য প্রকারের আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদী দের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রায় একরকম হলেও এখন যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয় কেবলমাত্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, তাই আমরা কোনও প্রতিষ্ঠানে আণবিক স্তরের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের বৈশিষ্ট্য গুলো দেখে নেবো যাতে করে আমরা তাদের অনায়াসে সনাক্ত করতে পারি । সেগুলি হল—
১) নিজের multidimensional identity-র বিস্মরণ ।
২) অন্যান্য identity গৌণ করণ ।
৩) কেবল ধর্মীয় আইডেন্টিটি কে মানুষের একমাত্র identity হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান ।
৪) ‘ভালো মানুষ হওয়ার একমাত্র অর্থ ভালো ধার্মিক হওয়া’—এই মিথ্যা বিশ্বাসের ( false belief) প্রতিপালন ।
একটু বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন — আমরা তো মানুষ । আমাদের act এবং behaviour বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। এবং আমাদের এই act এবং behaviour আমাদের আইডেন্টিটি নির্ধারণ করে । যেমন আমি লাইব্রেরী তে গেলে আগে দর্শনের বই বের করে পড়ি , সেখানে আমার identity তৈরি হয় যে আমি দর্শনে আগ্রহী । আমার মহল্লায় আমি একজন মুসলিম বংশজাত , শিক্ষাক্ষেত্রে আমি ডাবল এম এ ডিগ্রী ধারী । ফেসবুকে আমি নাস্তিক ব্লগার । আমি শখের ফটোগ্রাফারও । এগুলো সব আমার এক একটা identity । এদের একসাথে একটা মানুষের মধ্যে থাকতে কোনও বাধা তো নেই-ই বরং একসাথে অনেক identity থাকাই স্বাভাবিক। আর তা থাকেও । এই জন্য নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, প্রতিটি মানুষের identity multi- dimensional ।
কিন্তু এই ধরনের মানুষ গুলো নিজেরা multi-dimensional act ও behaviour করলেও নিজের multi dimensional identity গোপন করেন, অপরের এবং নিজের কাছেও । নিজের উপর মিথ্যা বিশ্বাস আরোপ করেন , নিজের কাছে দেখানোর চেষ্টা করেন যে তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি , ধর্মীয় পরিচিতি ই যার একমাত্র পরিচিতি , এছাড়া তার অন্য কোনও পরিচিতি নেই । আর অন্যের কাছ থেকে ও আশা করেন যে অন্যেরা যেন তার ধর্মীয় identity দ্বারাই তাকে চেনে । শুধু এইটুকু করলে তেমন কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু তারা অন্যান্য মানুষের identity -র বাকি সকল dimension গুলির উপর গুরুত্ব না দিয়ে কেবল মাত্র ধর্মীয় আইডেন্টিটি দ্বারাই মানুষের মূল্যায়ন করেন যে, মানুষটি ভালো না খারাপ । এবং ধর্মীয় identity কেই মানুষের একমাত্র আইডেন্টিটি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠেন । আর এখান থেকেই শুরু হয় যত সমস্যার । এদের মতে ভাল মানুষ হওয়ার একমাত্র শর্ত হল ভাল ধার্মিক হওয়া । ফলে তারা প্রাচীনকালে ধর্মীয় পদ্ধতিতে বিশ্বাস রেখে বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেন ।
পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মানুষদের মধ্যে এই ধরনের লোক বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে । যদি ও বা দুই একটা আছে তবু প্রতিকূল পরিবেশে তারা অন্যের উপর বলপ্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টি করতে সাহস পায় না । এরা তেমন গুরুত্ব ও পায় না সেই সমাজে । তাছাড়া কোনও ধর্ম যদি যুগে যুগে নিজেকে পরিবর্তন করে , যুগোপযোগী করে, তাহলে এই সমস্যা আসার সম্ভাবনা কমে যায় । বর্তমানে প্রায় সব ধর্মই নিজেকে পালটে ফেলেছে । কিন্তু আজ ও পৃথিবী তে ইসলাম ধর্ম তাদের দেড় হাজার বছরের পুরনো বিশ্বাসে rigid । তাই মুসলিম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে আণবিক স্তরে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দেখা যায় না । কেবলমাত্র পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের মুসলিম দের মধ্যেই এই ধরনের মানুষের প্রাচুর্য দেখতে পাওয়া যায় । যার অনিবার্য ফল হল মূল ধারার সন্ত্রাসবাদ এর ভিত মজবুত করা ।
এরা কিভাবে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ? এই প্রশ্নটি তো অবশ্যম্ভাবী ভাবেই চলে আসে । যদিও এতক্ষণে সকলেই হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন আমার সিদ্ধান্ত টি , তা সত্ত্বেও বলে নিতে চাই । আসলে এইসব মানুষেরা নিজের পরিচিত গণ্ডি বিশেষত পরিবারে ধর্মীয় পরিস্থিতি কায়েম করতে খালি বলপ্রয়োগ নয় , ছল এবং কৌশলেরও সমান ভাবে প্রয়োগ করেন । ফলে, সেই সব পরিবারের মানুষজন নিজেকে আতঙ্কের মধ্যে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলে এই আতঙ্কের পরিবেশ তাদের কাছে নতুন কোনও প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে না , যে জন্য তারা প্রতিবাদে নামবেন । দ্বিতীয়ত , ওই মানুষ গুলোকে সমাজে একটু বেশি সমীহ পেতে দেখে তার পরিবারের সদস্যরা মনে করে যে ওই ব্যক্তিই ঠিক । তাছাড়া নিয়মিত পবিত্র হয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়ার ফলে একটি বিশেষ মানসিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাকে ‘গুণের স্থানান্তরণ’ বলতে পারি ( যেমন শুনতে পাই—‘নিজে ভালো, তো জগত ভালো’ এই খেত্রেও একই ঘটনা ঘটে)। ফলে মনে হয় গ্রন্থটি সত্যিই পবিত্র । ফলে পাঠকেরা সিদ্ধান্ত করে বসে যে গ্রন্থটি সত্যিই স্রস্টার কাছ থেকে এসেছে , এবং সেইজন্য তা অভ্রান্ত । এই অভ্রান্ততায় বিশ্বাস , যার প্রকৃত কারণ আসলে বলপ্রয়োগ । আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদীদের বলপ্রয়োগ ।ফলে এইসব পরিবারের মানুষজনও নিজের অজান্তেই অতি ধীর ও নিঃশব্দ গতিতে আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদী তে পরিণত হয় । এরাও একসময় ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থক হয়ে ওঠেন । হয়ে ওঠেন প্রশ্রয়দাতা । শুধু তা-ই নয় , সামান্য প্রশিক্ষণে এবং মস্তিষ্ক প্রক্ষালনে এরা হাতে অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধা করেন না ।
এই পরিস্থিতিই ইসলামে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে দিন দিন প্রসারিত করে চলেছে । আধুনিক পৃথিবীর কাছে যা হয়ে উঠছে সাক্ষাৎ ভীতিস্বরূপ। যেদিন আমরা নিজেদের পরিবার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে আণবিক স্তরের সন্ত্রাসবাদীদের সনাক্ত করতে পারবো, তাদের মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের আসল চেহারা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে পারবো , জনমত গড়ে তুলতে পারবো এদের বিরুদ্ধে , সেদিন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীরা জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে । আর জনসমর্থন ছাড়া যেহেতু কোনও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বেশিদিন চলতে পারে না , তাই সেদিন থেকে অনিবার্য ভাবেই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদও আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে ।

No comments:

Post a Comment